|
|
|
|
যাঁদের স্পর্শে আলোকিত মন, দীপ্ত জীবন |
কে বলেছে, সরকারি ইস্কুলে কিস্যু হয় না? |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
আজ শিক্ষক দিবস। বহু সমস্যার মধ্যে, সামান্য উপকরণ দিয়ে যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা
অসামান্য কাজ করে চলেছেন, তাঁদের কুর্নিশ করে আনন্দবাজারের এই নিবেদন। |
পড়ুয়া ৫৭ জন। শিক্ষক মাত্র এক জন। তা বলে, সরকারি স্কুলে কিছু হয় না, এই অপবাদ ঘুচিয়ে দিয়েছেন স্বরূপচন্দ্র বিশুই। ঝাড়গ্রাম ব্লকের জঙ্গলঘেরা প্রত্যন্ত কুমারী গ্রামের ‘কুমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’র ভোল বদলে দিয়েছেন বছর আটত্রিশের এই প্রধান শিক্ষক। তিনি একাই একশো। গ্রামবাসী থেকে স্কুল শিক্ষা দফতরের আধিকারিক, সকলেই একবাক্যে মানছেন, কুমারী গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়কে গত দশ বছরে তিলে তিলে সাজিয়ে আদর্শ স্কুল হিসেবে গড়ে তুলেছেন স্বরূপবাবু। ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা এই শিক্ষক প্রতিদিন গড়ে দশ ঘন্টা নিজের স্কুলে কাটান। শিশু-মিত্র বিদ্যালয়ের জন্য স্কুলটিকে মনোনয়নের তালিকায় রেখেছে স্কুল শিক্ষা দফতর। কুমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখন স্বয়ং সম্পূর্ণ।
স্কুলটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে। ২০০৩ সালে স্বরূপবাবু যখন প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, তখন ছিল দু’কামরার ছোট্ট স্কুল ভবন। এখন সর্বশিক্ষা মিশনের অনুদানে স্কুলের অতিরিক্ত বড়সড় শ্রেণিকক্ষ তৈরি হয়েছে। গ্রামবাসী ও নিজের তরফে সংগৃহীত টাকায় শ্রেণিকক্ষে চারটি বৈদ্যুতিক পাখা লাগিয়েছেন স্বরূপবাবু। রয়েছে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা। স্কুলে দু’টি শৌচাগার। এর মধ্যে একটি মেয়েদের জন্য। দেওয়ালে লেখা স্বাস্থ্যবিধান। মিড-ডে মিলের জন্য রয়েছে আলাদা রান্নাঘর। সাব-মার্সিবল পাম্পে স্কুলের ছাদের ট্যাঙ্কে জল তুলে ওয়াটার পিউরিফায়ার যন্ত্রের মাধ্যমে পরিস্রুত করা হয়। মিড-ডে মিল রান্নায় সেই জল ব্যবহার হয়। পড়ুয়ারাও তাই পান করে। স্কুল প্রাঙ্গণে দু’টি টিউবওয়েলও রয়েছে। প্রতিদিন পড়ুয়াদের মধ্যে কোন ক্লাসে কতজন উপস্থিত থাকে সেই তথ্য পাওয়া যাবে বোর্ডে। দুপুরের খাবারের সাপ্তাহিক মেনুও লেখা থাকে। যেমন, মাসের চতুর্থ সোমবার ভাত, ডাল ও মুরগির মাংস। কোনও দিন ডিমের ঝোল, কোনও দিন আবার ডাল ও আলু-পটলের তরকারি বা পুঁই-কুমড়োর চচ্চড়ি। স্কুলের দেওয়ালে থানা, দমকল, হাসপাতালের মতো জরুরি পরিষেবার টেলিফোন নম্বরও লেখা হয়েছে। |
|
কুমারী প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়াদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক স্বরূপচন্দ্র বিশুই। ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
সর্বশিক্ষা মিশন থেকে প্রতি বছর পড়ুয়া পিছু ইউনিফর্মের জন্য ৪০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়। সেই টাকায় স্বরূপবাবু পড়ুয়াদের ইউনিফর্ম, ব্যাচ, জুতো ও স্কুল ব্যাগ দেন। এ জন্য নিজের রোজগার থেকেও টাকা খরচ করেন স্বরূপবাবু। নিজের চেষ্টা আর ইচ্ছের জোরেই এ সব কিছু করেছেন স্বরূপবাবু। দুঃখ একটাই। বছর খানেক ধরে দ্বিতীয় কোনও শিক্ষক না থাকায় শিশুশ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীকে স্কুলের বারন্দায় ক্লাস করতে হয়।
এত কিছু সামলান কী করে? স্বরূপবাবু জানালেন, প্রতিদিন নিয়ম করে ভোর সাড়ে ছ’টায় স্কুলে চলে আসেন তিনি। নিজের ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও এলাকার মাধ্যমিক স্তরের পড়ুয়াদেরও নিখরচায় টিউশন পড়ান তিনি। গ্রামবাসীরা পালা করে স্বরূপবাবুর জন্য চা, জলখাবারের ব্যবস্থা করেন। এরপর সকাল এগারোটায় স্কুল শুরুর আগে প্রতিদিন পড়ুয়াদের নিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণ ও শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করেন স্বরূপবাবু। দুপুরে টিফিনে পড়ুয়ারা যখন মিড-ডে মিল খায়, তখন স্বরূপবাবুর জন্য দুপুরের খাবার আসে গ্রামের কোনও না কোনও বাড়ি থেকে। গ্রামের বধূ দময়ন্তী মাহাতোর কথায়, “মাস্টারমশাই নিঃস্বার্থ ভাবে নিজেকে এই গ্রামের স্কুলের জন্য উৎসর্গ করেছেন। উনি আমাদের আপনজন।” গ্রামবাসী যজ্ঞেশ্বর মাহাতো, অমিত পাণ্ডে, বুদ্ধেশ্বর মাহাতোদের বক্তব্য, “মাস্টারমশাই আসার পর আমাদের গাঁয়ের স্কুলটির ভোল বদলে গেছে। ছেলেমেয়েরা ভাল ফল করে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চতর স্কুল ও কলেজে পড়ছে। গ্রীষ্ম ও পুজোর ছুটির সময়ও মাস্টারমশাই সপ্তাহে দু’দিন স্কুলে এসে ছেলেমেয়েদের পড়ান। স্কুলে অন্তত আর এক জন শিক্ষক থাকলে আরও ভাল হত।” গ্রামবাসীরা জানালেন, কোনও পড়ুয়া স্কুলে না গেলে বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেন মাস্টারমশাই। সমস্যার কথা জানতে চান। এ জন্য প্রতিদিনই পড়ুয়াদের গড় উপস্থিতি ৫৫-৫৬ জন। স্কুল পড়ুয়া দ্বিতীয় শ্রেণির শুভদীপ সরেন, তৃতীয় শ্রেণির দীপান্বিতা রানা, চতুর্থ শ্রেণির পুষ্পেন্দু পাতর, মধুমিতা মাহাতোরা জানাল, “মাস্টারমশাই আমাদের ইংরেজিতে কথা বলতে শিখিয়েছেন।” স্কুল প্রাঙ্গণে দেবদারু ও ঝাউগাছ লাগিয়েছেন স্বরূপবাবু। গ্রামের প্রবীণ রসময় পাতর গাছগুলির নিয়মিত পরিচর্যা করেন। স্কুলে কোনও প্রাচীর নেই। গ্রামবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে প্রাচীরের কিছু অংশ তৈরি হয়েছে। অর্থাভাবে কাজ সম্পূর্ণ করা যায়নি।
নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন স্বরূপবাবু। তাঁর আদি বাড়ি বিনপুরের চিয়ানবেড়া গ্রামে। ১৯৯৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন তিনি। কিন্তু তাঁর বাবা অর্থাভাবে পড়াতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। পকেটে ৫ টাকা সম্বল করে ঝাড়গ্রামে চলে আসেন স্বরূপবাবু। চা দোকানে কাজ করে, টিউশন করে আধপেটা খেয়ে নিজের খরচ জোগাড় করে বেসিক ট্রেনিং নেন। ১৯৯৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পান। প্রথমে একতাল গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে সহ শিক্ষক। ২০০৩ সালে বদলি হয়ে আসেন কুমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাকিটা ইতিহাস। কুমারী স্কুলে যখন প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন, তখন একজন সহ-শিক্ষকও ছিলেন। কিন্তু জঙ্গলমহলের অশান্তি পর্বে বছর তিনেক আগে ওই শিক্ষক অন্যত্র বদলি নিয়ে চলে যান। স্বরূপবাবু কিন্তু অস্থির সময়েও নিয়মিত স্কুল করে গিয়েছেন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফের আর একজন সহ-শিক্ষক স্কুলে যোগ দেন। কিন্তু গত বছর জুলাইয়ে ওই শিক্ষকটি অন্য চাকরি পেয়ে চলে যান। তারপর থেকে এক বছর ধরে একাই স্কুল সামলাচ্ছেন স্বরূপবাবু। জরুরি কাজ পড়লে মর্নিং স্কুল করেন। কিন্তু কোনও দিন স্কুল বন্ধ করেননি। স্বরূপবাবুর কথায়, “সরকারি স্কুলে কিছু হয় না, এই ধারণাটা আমি ভেঙে দিতে চাই। সরকারের সব রকম সুযোগ সুবিধা রয়েছে, সেগুলি আদায় করে নিতে পারলে যে কোনও সরকারি স্কুলই আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। শুধু সদিচ্ছাটুকু থাকলেই অসাধ্যসাধন করা যায়।” নিজের ৯ বছরের মেয়েকেও তাই ঝাড়গ্রামের একটি সরকারি স্কুলে ভর্তি করেছেন স্বরূপবাবু।
ঝাড়গ্রাম পূর্ব চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক নবেন্দুবিকাশ গিরি বলেন, “স্বরূপবাবু স্কুলটিকে আদর্শ স্কুলে পরিণত করেছেন। ওঁর কোনও তুলনা হয় না। গত বছর স্কুলটি সর্বশিক্ষা মিশন থেকে নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার পেয়েছে। ওই স্কুলে সহ শিক্ষক দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।” |
|
|
|
|
|