আশা হয়, বদলে যাওয়া সময়ে আদর্শ শিক্ষক বলতে শুধু ধুতি-চাদর বা শার্ট-প্যান্ট পরা মাস্টারমশাইদের
কথাই সব জায়গা দখল করে থাকবে না, সেই আখ্যানে সসম্মান অধিষ্ঠিত থাকবেন সুপ্রিয়া চৌধুরীরা। |
আমার প্রথম চাকরি খিদিরপুর কলেজে। ২০০৩-এর মে মাসে স্টাফ রুমে প্রথম যে দিন ঢুকেছিলাম, সে দিন ওই বসার ঘরে সংখ্যার বিচারে কোনও লিঙ্গবৈষম্য চোখে পড়েনি। ‘পুরুষ’ আর ‘মহিলা’ শিক্ষকদের হার প্রায় সমান সমান। এর কয়েক বছর পরেই কলেজে যখন ‘নাক’-এর নজরদারির মুখোমুখি হতে হল, তখন খেয়াল করলাম আমাদের কলেজে মহিলা শিক্ষকদের কাজের গোছ, কাজের প্রতি মনোযোগ, সব কিছুই পুরুষ শিক্ষকদের চেয়ে ঢের বেশি। ইতিহাসের রুমাদি, কমার্সের সোহাগদি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সুদক্ষিণাদি, হিন্দির রুপাদি, সবাই একাই একশো। বেশ লাগল, তবে একটা প্রশ্নও উঁকি দিল। এঁরা সকলেই মনোযোগী শিক্ষাকর্মী, অথচ সেই ২০০৪ সালেও আদর্শ শিক্ষক বলতে সচরাচর কিন্তু আমরা মেয়েদের বুঝতাম না। চোখ বন্ধ করলেই আমাদের মনের মধ্যে শিক্ষক হিসেবে দুর্মর সংস্কারের মতো সব সময়েই ভেসে উঠতেন বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, আশুতোষ, কিংবা ছাঁচ-ভাঙা ডিরোজিয়ো। কোনও শিক্ষিকা
নন। কেন?
এক দিক থেকে উত্তরটা সোজা। রুমাদির কাছেই শোনা, ওঁরা যখন কলেজের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেই ষাটের দশকে পুরুষ-প্রবল স্টাফ রুমের এক দিকে তিন-চার জন মহিলা শিক্ষক একসঙ্গে পাশাপাশি বসতেন। |
এই যদি স্বাধীনতার বেশ কয়েক দশক পরের ছবি হয়, তা হলে উনিশ শতকে বাঙালি যখন পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষায় সবে জেগে উঠছিল তখনকার ছবি তো আরও ‘শ্রী’হীন হবেই। শিক্ষার উচ্চ স্তরে মহিলা শিক্ষক প্রায় নজরেই পড়ত না, পড়বে কেমন করে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো পড়াশোনার জগতে মহিলাদের ঢুকতে দিতেই নারাজ ছিল। সমঝোতা করে মহিলাদের জন্যে চালু হয়েছিল সমান্তরাল অন্তঃপুর-শিক্ষা। আসলে পিটুলিগোলা। তাতেই সমাজ সে দিন আঁতকে আঁতকে উঠছে। আর যাঁরা বিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা অবধি যেতেন, সেই ‘পাশ-করা মাগ’দের নিয়ে তো কত কথা! পড়াশোনা শিখলে নাকি বাড়ির কাজ করবে না, ছেলেপুলে মানুষ করবে না, গুরুজনদের কথা শুনবে না, স্বামীকে পায়ের তলায় রাখবে, গর্ভধারণের ক্ষমতা পর্যন্ত নষ্ট হবে। এই সমাজে ক’জন মেয়ে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পাবেন, আর পেলেই বা আদর্শ শিক্ষকের তালিকায় স্থান পাবেন কী করে?
কিন্তু এ গল্প তো বেশ পুরনো। একুশ শতকে এ কাহিনি তো ইতিহাসপাঠ্য। আজ তো শিক্ষার ভুবনে ঝকঝকে মহিলাদের অভাব নেই। তা হলে আজও কেন এই নীরবতা? আসলে অভ্যেস যেতে যেতেও যায় না। যে ভাবে দেখে এসেছি, সে ভাবেই দেখে চলি আমরা। পুরুষতন্ত্রের দুর্মর প্রভাব মহিলাদের কৃতিকে ভুলে থাকতে বলে।
আর যেখানে ভুলে থাকতে বলে না, সেখানে পুরুষতন্ত্র নিজের সুবিধে মতো বিশেষ ভূমিকায় মেয়েদের সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। মহিলা শিক্ষক মানে যেন দু’রকম শো-পিস। এক নম্বর, চশমা পরা স্নেহময়ী, আবার প্রয়োজনে রাগী ও খিটখিটে, দিদিমণিমাত্র। বাড়িতে যেমন মা দিদিরা থাকেন, এঁরা তেমনই। অন্তঃপুরের এক্সটেনশন কাজে বাইরে যাচ্ছেন বটে, কিন্তু সেখানেও অন্তঃপুরের সাবেক ভূমিকাটাই পালন করতে বলা হচ্ছে। তাঁদের শিক্ষা দেওয়ার, পড়াশোনা করার, চিন্তা করার সামর্থ্যকে মোটেই স্বীকার করা হচ্ছে না। সমাজের চোখে এঁরা নিতান্তই গ্লোরিফায়েড ‘পালিকা’।
দু’নম্বর মূর্তিটি হল: পরম রমণীয়া। স্কুলকলেজে তাঁদের দেখে দিল হুম হুম করবে। উনিশ শতকে ‘পাশ-করা মাগ’দের রক্ষণশীল সমাজ চোখ দিয়ে চাটত আর প্রকাশ্যে বটতলার বইতে তাদের ভ্যাম্প বানাত। এ কালে ভ্যাম্প বানায় না, ইনফ্যাচুয়েশনের বিষয় করে তোলে। ‘ম্যায় হুঁ না’ ছবির বয়স্ক ছাত্র শাহরুখ খান শিক্ষিকা সুস্মিতা সেনকে দেখে রোমাঞ্চে শিউরে শিউরে ওঠে, সুস্মিতা সেনের মগজ আছে কি না সে কথা ভাবতেই চায় না। ‘পালিকা’ আর ‘রমণীয়া’, এই দুই পুরুষতান্ত্রিক ছাঁচ মহিলাদের খাটো করছে।
দুটি ভাবমূর্তিকে এক স্তরে রাখলে ভুল হবে। দিদি বা মা ভাবমূর্তির কিছু সুবিধে আছে। শিক্ষার নানা স্তরে যে মহিলারা অনলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরা দিদি বা মা ভাবমূর্তির সুবাদেই সহজে এনট্রি পান। প্রাথমিক শিক্ষার দিদিমণিরা সহজেই ঢুকে পড়েন গ্রামসমাজ ও পারিবারিক সমস্যার কেন্দ্রে। একই ছবি শহরের স্কুলেও, বিশেষ করে বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলিতে, যেখানে প্রধানত নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। ছাত্রছাত্রীরা মহিলা শিক্ষকদের কাছে নিজেদের সমস্যা, বাড়ির সমস্যার কথা অনেক সহজে অকপটে বলতে পারে, আবদার করতে পারে। ছোটবেলায় শেখার সহজ পাঠও মহিলা শিক্ষকরা অনেক ভাল দিতে পারেন, দেন। সেই যে, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলতেন না তিনি ভাষা শিখেছেন তাঁর মায়ের কাছে। কিন্তু তাঁদের যেন শুধু এটুকুতেই আটকে রাখা না হয়। তাঁদের অন্যান্য সামর্থ্যের স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।
আর বড় বেলায়? আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মন শিপ্রা সরকারের মতো ‘মাস্টারমশাই’কে ভুলে গেছে। ভুলে গেছে, শুধু ভাল করে পড়ানোই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। সে জন্য কী অসম্ভব পরিশ্রম করতেন তিনি! তবে সুখের কথা, ছাঁচটা ভাঙছে। সে দিন সোশাল নেটওয়ার্কে চোখে পড়ল একটি ছবি। ছবিটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের করিডরে তোলা। ছেলেমেয়েদের আবদারে ক্রিকেট ব্যাট হাতে দাঁড়িয়েছেন সুপ্রিয়া চৌধুরী। সুপ্রিয়াদি তো কেবল ইংরেজির নিমগ্ন শিক্ষক বা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত নন, তাঁর প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা জানেন খেলাধুলাতেও তাঁর উৎসাহের শেষ নেই। তাই ব্যাট হাতে তাঁকে কুর্নিশ করেন তাঁরা। তাঁর প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা বলেন, লেখেন তাঁর কথা।
এই সব দেখে একটু আশা হয়, বদলে যাওয়া সময়ে আদর্শ শিক্ষক বলতে শুধু ধুতি-চাদর বা শার্ট-প্যান্ট পরা মাস্টারমশাইদের কথাই সব জায়গা দখল করে থাকবে না, সেই আখ্যানে সসম্মান অধিষ্ঠিত থাকবেন সুপ্রিয়া চৌধুরীরা। |
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |