শিক্ষার পরিসরে নতুন বাস্তব নির্মাণের দায়িত্ব শিক্ষকদেরই। আমার ছাত্র, আমারই ছাত্র। তাকে
প্রয়োজনে বকব, আবার তার সঙ্গেই খোলা মনে আড্ডাও মারব। চায়ের
দোকানে তাকে ডেকে নেব। রাজা-উজির মারতেও তাকেই চাই। |
পশ্চিমবঙ্গে একটি নতুন ‘আমরা-ওরা’-র পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ‘আমরা’ হলাম শিক্ষক-অধ্যক্ষ ইত্যাদি আর ‘ওরা’ হল বহু দলে বিভক্ত ছাত্রসমাজ। সম্প্রতি তারা পরস্পরের মুখোমুখি। কখনও অধ্যক্ষের হাতে বাইকের চেন দিয়ে মার, কখনও বা পরীক্ষায় নকল না করতে দেওয়ার অপরাধে শিক্ষকের চোখে ঘুষি বা কলেজ ভাঙচুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক আক্রান্ত। তাঁর গাড়ির উপর উন্মত্ত ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ইটাহার, হরিরামপুর বা সন্দেশখালির কালীনগর কলেজের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে স্বয়ং রাজ্যপালকেও। বিশ্বভারতী বাদে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মাননীয় রাজ্যপাল বলেছেন এই সব ছাত্রকে ধরে পেটাতে। সারা বিশ্বে শিক্ষাক্ষেত্রে কর্পোরাল পানিশমেন্ট-এর বিরুদ্ধে সভ্য জনমত গড়ে উঠলেও আচার্য মহাশয়ের এ হেন নিদান অবশ্যই কিছুটা আশ্চর্যজনক। এটা একটি পন্থা, নিশ্চয়ই। কিন্তু একমাত্র পন্থা নয়, কাম্য তো নয়ই।
অথচ পাল্টা তর্ক উঠবেই। শিক্ষক-অধ্যক্ষরা কি শুধুই নানা ছুতোয় মার খাবেন? শিক্ষাঙ্গনে আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হলে তার মোকাবিলায় পুলিশ-র্যাফ ইত্যাদি আসবে না কেন? মারমুখী ছাত্রদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে না কেন? ঠিকই। আইন লঙ্ঘন করলে তদনুযায়ী শাস্তি পেতেই হবে। সে ক্ষেত্রে ইটাহারে শাসক দলের কর্মীরা বাড়িতে বসে থাকবেন আর সন্দেশখালির
এস এফ আই হলেই তাঁকে আটক করা হবে এমন নিয়ম দিয়ে আইনের শাসন চলে না। ‘মাঝদিয়ায় জেল আর রায়গঞ্জে বেল’ আসলে একুশে আইনের নামান্তর মাত্র। প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট হলে রাজ্যপালের দাওয়াইও তো কাজে আসবে না। পেটাতে হলে সবাইকে সমহারে পেটাতে হবে। |
হাতে হাত। ম্যারাথন দৌড়ে ছাত্র ও শিক্ষকরা। বোকারো, ২০১২। ছবি: পঙ্কজ সিংহ |
কিন্তু গভীর প্রশ্নটা সেখানে নয়। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এমন তলানিতে কী ভাবে পৌঁছল, তার একটা অনুসন্ধান প্রয়োজন। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ুয়াদের মধ্যে একটু দুষ্টুমির প্রবণতা থাকেই। তাকে অল্পবিস্তর স্নেহের শাসনে বেঁধে রাখার দায়িত্ব শিক্ষকদেরই। আজকের শিক্ষকরা কি ছাত্রদের সঙ্গে সেই মেলামেশার জায়গাটিই নষ্ট করে ফেলছেন? অতি-নিয়মতান্ত্রিকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ থেকে আমরা ছাত্রদের কিছু স্বাভাবিক বিচ্যুতিকেই অসামান্য করে তুলছি না তো?
প্রশ্ন উঠবে, পরীক্ষায় টোকাটুকি স্বাভাবিক বিচ্যুতি, না কি গুরুত্বপূর্ণ আইন লঙ্ঘন? ঠিকই। পড়ুয়াদের কখনওই পরীক্ষাকেন্দ্রে অসৎ উপায় অবলম্বন করা উচিত নয়। কিন্তু সে তো অতি আদর্শ ব্যবস্থা, যেখানে শিক্ষকরাও তাঁদের পুরো পাঠদানের কাজটা শিক্ষাঙ্গনেই করবেন। ছাত্রদের অর্থের বিনিময়ে নিজেদের গৃহে নিয়ে যাবেন না। ক্লাসে বসে শুধু নোট পড়ে দিয়ে চলে আসবেন না, একটু বোঝাবেনও। এক জন শিক্ষক একটি এক ঘণ্টার ক্লাসে বই বা নোট ছাড়া নিজের বিষয়ে যদি এক লাইনও বোঝাতে অপারগ হন, তবে তিনি কী ভাবে আশা করেন যে পড়ুয়ারা তিন-চার ঘণ্টার পরীক্ষায় একটি পুরো পেপার ঝাড়া মুখস্থ লিখে যাবে? অতি অল্প সংখ্যক শিক্ষকই হয়তো প্রাইভেট টিউশন বা নোট-সর্বস্ব শিক্ষাদানে অভ্যস্ত। নকল করা ছাত্রদের সংখ্যাও বিশাল কিছু নয়। কিন্তু উভয়ের মধ্যে এক প্রকার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রয়েছে। শিক্ষকরা পড়ানোর পদ্ধতি পাল্টানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি আনছেন এবং হাতে বই বা নোট না-রেখে শুধু একটি স্টিক নিয়ে ঘাড় কাত করে ওভারহেড প্রজেক্টর দেখে পড়িয়ে যাচ্ছেন। অথচ পরীক্ষাকেন্দ্রে পড়ুয়ারা ঘাড় ঘোরাতে পারবেন না। কেন?
আমার মাতামহ ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (ধীমু) ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছাত্র ও পরবর্তী কালে আশ্রমের শিক্ষক। তাঁর ‘আশ্রমস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখছেন: ‘‘কখনও কখনও গুরুদেবের কাছ থেকে ভর্ৎসনাও পেয়েছি। আহারের ঘরে একবার কিছুদিন গুরুদেব সকলের সঙ্গে খেতেন। রন্ধনশালার কাছেই একটা উঁচু চাতালের উপর আমরা কয়েকটি ব্রাহ্মণ ছাত্র পৃথক বসতাম। আমাদের সঙ্গে দুই-একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ মাস্টারমশাইও বসতেন। একটু নীচে লম্বা আহারের ঘরে জাতি নির্বিশেষে অন্যান্য ছাত্র শিক্ষক বসতেন। তারই মধ্যে গুরুদেব বসতেন। আমরা জাত্যভিমানীরা দূর থেকে গুরুদেব কী খেতেন কোনোদিন দেখিনি, জানতেও চেষ্টা করিনি। আহারের সময় অনাবশ্যক কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। গুরুদেবের থেকে আমরা দূরে খেতে বসতাম, সুতরাং আমরা সে নিয়মটা তত পালন করতাম না। একদিন অন্য সময়ে যেই গুরুদেবকে প্রণাম করতে গিয়েছি, অমনি তিনি একটু সরে গিয়ে বললেন, ‘ব্রাহ্মণত্বের বড়াই কর, অথচ ব্রাহ্মণের পালনীয় নিয়ম পালন কর না।’ আমি তো স্তম্ভিত ও মর্মাহত।” (পৃ ২৯) শিক্ষাক্ষেত্রে যুদ্ধ ঘোষণা না করে আমরা যদি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটাকে মেরামত করি, তবেই অনেকটা পথ পেরোতে পারব। যার যা কাজ সেটা করেও যদি উভয় তরফের কেউ বিচ্যুত হই, মুখোমুখি বসে সামলে নেওয়া যাবে। নকল করা ছাত্রের কাউন্সেলিং প্রয়োজন। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষকরাই ঘর-পাহারায় থাকেন, পুলিশ নয়। তাই তাঁরাই ভেবে দেখতে পারেন, প্রয়োজনে সামান্য বিষয়গত সাহায্য করে যদি ছাত্রদের পুরো নকল করার প্রবণতা কমানো হয়। প্রশ্নপত্র দেখে একেবারে বিভ্রান্ত হয়ে পড়া ছাত্রকে একটু ভরসা দিলে সে অনেকটা উত্তর দিতে পারে। শিক্ষককে এটুকু মাঝেসাঝে করতেই হয়। অথবা পরীক্ষা ব্যবস্থাটাকেই পরিবর্তন করা উচিত। মৌখিক প্রশ্ন, প্রজেক্ট ওয়ার্ক বা টীকা-ভিত্তিক উত্তরদানের মাধ্যমে মূল্যায়ন করলে প্রাইভেট টিউশনের রমরমা এবং টোকাটুকি উভয় প্রবণতাই হ্রাস পেতে পারে। অবশ্য এ সব
কিছুর জন্যই শিক্ষা ব্যবস্থার অভ্যন্তরে একটি আলোড়ন প্রয়োজন।
আর এই আলোড়ন তৈরির কাজটি করতে হবে শিক্ষকদেরই। ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর মধ্যে সেতুবন্ধনের মাধ্যমেই শিক্ষাঙ্গন প্রকৃত হিংসামুক্ত হতে পারে। আমরা জানি যে, বহিরাগতরাই শিক্ষাঙ্গনে সমস্যা জন্ম দেয়। হিংসাত্মক পরিস্থিতির জন্য বাইরের রাজনীতিই দায়ী। অথচ, কী আশ্চর্য, শিক্ষাঙ্গনে যে কোনও সমস্যার সমাধানে আমরা বাইরের সাহায্যই সবার আগে চাই। এবং সে সাহায্য রাজনৈতিক। বিভিন্ন সংগঠনের ছাত্রনেতারা জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন। আমরা সে সব শুনি। তাঁরা বলেন না যে, কলেজের সমস্যা কলেজেই সমাধান করতে হবে এবং এখানে আমাদের কিছু করার নেই। সমস্যা হাতের বাইরে চলে গেলে পুলিশ ডাকতে রাজ্যপাল বা মন্ত্রী-সান্ত্রিদের লাগবে না, কলেজের অধ্যক্ষই যথেষ্ট। নেতারা এ কথা বলেন না, কারণ তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থ আছে। কিন্তু শিক্ষকদের তো সে স্বার্থ নেই। অন্তত সবার নেই। তাঁরা শিক্ষাঙ্গনে একটা ভিন্ন বাস্তবতার জন্ম দিতেই পারেন। সমাজজীবন সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চা ও স্বার্থবহ সমাজচেতনা এক বস্তু নয়। ছাত্র, শিক্ষকেরা যদি শিক্ষাঙ্গনের স্বার্থ অপেক্ষা বাইরের রাজনৈতিক গোষ্ঠীজীবনের প্রতি আনুগত্যকেই অধিকতর গুরুত্ব দেন, তবে অনৈক্যই বিদ্যমান থাকবে, শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ফিরবে না। আক্রান্ত শিক্ষক অথবা মুখর পড়ুয়াদের দলীয় পরিচিতি নিয়েই আমরা দৃশ্যগ্রাহ্য মাধ্যমে অহেতুক কোলাহলে মত্ত থাকব।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে ইতিবাচক আবেগের ঘনঘটা রয়েছে, তা অন্য ক্ষেত্রে নেই, এটা দুঃখের। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই যদি মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নবলয়ে স্থান পেত, তবে বড়ই ভাল হত। অবশ্য তাঁর অত সময় কোথায়? অন্তত প্রশাসনকে নিরপেক্ষ আচরণ করতে বলা যায়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করে নেওয়া যায়। এটুকু করতে অর্থ বা সময় কোনওটারই অপচয় হবে না। ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্কের প্রধান অন্তরায় যে বাইরের গোষ্ঠী-রাজনীতি, তাকে সংযত করতে ওই পদক্ষেপ বিশেষ জরুরি।
আমার ছাত্র, আমারই ছাত্র। তাকে প্রয়োজনে বকব, আবার তার সঙ্গেই খোলা মনে আড্ডাও মারব। চায়ের দোকানে তাকে ডেকে নেব। রাজা-উজির মারতেও তাকেই চাই। পরীক্ষায় টুকতে দেব না অথচ প্রশ্নটা একটু ধরিয়ে দিতে বললে নিয়ম দেখাব না। আমার মগজে কারফিউ নেই, মাথায় পুলিশের টুপিও নেই। আছেন রবীন্দ্রনাথ, কবি ও শিক্ষক। ধীমু লিখছেন: ‘জ্যোৎস্নায় চারিদিক ভরে গিয়েছে অনেক রাত হয়েছে শান্তিনিকেতনের দ্বিতলের খোলা বারান্দা থেকে গুরুদেবের গান শোনা যাচ্ছে। আমি থাকি শিশু বিভাগে কোনোদিন বা ঐরকম জ্যোৎস্না রাতে গুরুদেব শালবীথিতে একাকী পায়চারী করছেন আর গুনগুন গান করছেন। একদিন রাত্রে মনে আছে কি বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছি জানালার কাছে আলো জ্বলছে, গুরুদেব এসে জাগিয়ে দিয়েছেন। ধড়ফড় করে উঠে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছি।’(পৃ ২৯)
|
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |