দেড় দশক পূর্বে যে ঘটনাটি ঘটিলে তাহার মাপ মহাজাগতিক হইত, আজ তাহা বিনাশের পিচ্ছিল পথে খড়কুটা আকড়াইবার মরিয়া প্রচেষ্টা রূপে প্রতিভাত হইতেছে মাত্র। মাইক্রোসফ্ট-এর নোকিয়া অধিগ্রহণ উপাখ্যানটি নায়কোত্তম, অতএব, এই দুইটি সংস্থার একটিও নহে সেই নায়কের নাম সময়। যে সময় তথ্যপ্রযুক্তির বাজারকে আমূল বদলাইয়া দিয়াছে। গত শতকের সত্তরের দশকে কম্পিউটারের বাজারে একচ্ছত্র অধিপতি ছিল আইবিএম নামক মার্কিন সংস্থাটি। মাইক্রো-সফ্ট নামক সদ্যোজাত একটি সংস্থা, শুধুমাত্র উদ্ভাবনী শক্তির মাহাত্ম্যে সেই বাজারটি জিতিয়া লইয়াছিল। সংস্থার নামের মধ্যবর্তী সংযোজক চিহ্ন খসিয়া পড়িতে সময় লাগিয়াছিল সামান্যই বাজারের উপর তাহার দখল স্থায়ী হইয়াছিল প্রায় দুই দশক। যে ভাবে আইবিএম-এর চেনা বাজারকে নিজের ক্ষমতায় বদলাইয়া লইয়া মাইক্রোসফ্ট তাহার দখল লইয়াছিল, ঠিক সেই কাহিনিই পুনরাবৃত্ত হইল এই দফায় মাইক্রোসফ্ট বিজিতের দলে, ফারাক শুধুমাত্র এইটুকুই। মানুষ কী ভাবে কম্পিউটার ব্যবহার করিতে চাহে, এই প্রাথমিক কথাটুকু না বুঝিবার খেসারত মাইক্রোসফ্ট দিয়াছে। অ্যাপ্ল, গুগ্ল আর ফেসবুক তাহার পায়ের তলার মাটি কাড়িয়া লইয়াছে। গান শুনিবার যন্ত্র হইতে সার্চ ইঞ্জিন, স্যোশাল নেটওয়ার্কিং হইতে ই-বুক, একবিংশ শতক তথ্যপ্রযুক্তির যে অনুষঙ্গগুলিকে অপরিহার্য জ্ঞান করে, মাইক্রোসফ্ট তাহার একটিরও উদ্ভাবক হইতে পারে নাই। যে উদ্ভাবনী শক্তি তাহার প্রকৃত মূলধন ছিল, তাহা সংস্থাটিকে ত্যাগ করিয়াছে। সংস্থাটি তাই প্রাণহীন।
কম্পিউটারের বাজারে মাইক্রোসফ্ট-এর যে প্রতিপত্তি ছিল, মোবাইল টেলিফোনের বাজারে নোকিয়া-র তাহার কিছুমাত্র কম ছিল না। কিন্তু সময় তাহাকেও ছাড়ে নাই। মোবাইল ফোন এখন আর শুধুমাত্র কথা বলিবার মাধ্যম নহে, তাহা একাধারে ক্যামেরা, গান শুনিবার যন্ত্র, ইন্টারনেট ব্যবহারের পথ ইত্যাদি। ‘স্মার্টফোন’ আসিয়া বাজারটির চরিত্র এমনই বদলাইয়া দিয়াছে যে নোকিয়া তাহার তল পায় নাই। মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বেও যে বাজারে তাহারা সিংহবিক্রমে রাজত্ব করিত, সেই বাজারে আজ সংস্থাটি নিতান্ত প্রান্তিক। মাইক্রোসফ্ট ও নোকিয়ার মিলন, এক ভাবে দেখিলে, সময়ের হাতে মার খাওয়া দুই একদা-মহানায়কের মিলন। কিন্তু, তাহারা সম্ভবত বিনাশের মোহনায় আসিয়া মিলিয়াছে এমন জায়গায়, যেখান হইতে ফিরিবার উপায় নাই। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সংস্থা দুইটি তাহাদের অতীতের ভ্রান্তি শুধরাইতে পারিবে কি না, উইন্ডোজ এইট অথবা নোকিয়া লুমিয়া তাহাদের হৃত গৌরব ফিরাইয়া দিতে পারিবে কি না, এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাইতে খুব বেশি অপেক্ষা করিতে হইবে না। কিন্তু যাহা এক্ষণে স্পষ্ট এবং অবশ্য শিক্ষণীয়, তাহা হইল, সময়কে অবজ্ঞা করিতে নাই। সময়কে ধরিবার একটিই পন্থা আছে যাহা কেউ এখনও ভাবিতে পারে নাই, তাহা ভাবিতে সফল হওয়া। অর্থাৎ, উদ্ভাবনী শক্তির জয়। ‘গুগ্ল আই’ নামক যে পণ্যটি বাজারে আসিতেছে, তাহা এই জয়ের পথের একটি মোক্ষম উদাহরণ। আর একটি উদাহরণ আই ফোন। নিত্যব্যবহার্য মোবাইল ফোনকে কী ভাবে বহু যন্ত্রের সম্মিলনে পরিণত করা যায়, তাহা স্টিভ জোবস-এর পূর্বে কেহ ভাবিতে পারেন নাই। ক্রেতা কী চায়, তাহা জানা জরুরি। আরও জরুরি, ক্রেতাকে কী চাওয়ানো যাইতে পারে, তাহা জানা। আশঙ্কা, মাইক্রোসফ্ট এবং নোকিয়া, উভয় সংস্থাই সেই জানার পথ হইতে বহু দূরে পড়িয়া আছে। |