পার্বত্য দার্জিলিঙের লেপচা জনজাতির নাগরিকদের জন্য স্বতন্ত্র উন্নয়ন পর্ষদের প্রস্তাবটি যে কোনও সস্তা চমক ছিল না, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাহা প্রমাণ করিলেন। মঙ্গলবার কালিম্পঙে লেপচা সম্প্রদায়ের ভিড় উপচানো জনসভায় তিনি যে সংবর্ধনা পাইলেন, তাহা অহেতুক নহে। তিনিই সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রাজনীতিক, যিনি লেপচাদের পার্বত্য দার্জিলিঙের ‘ভূমিপুত্র’ বলিয়া উল্লেখ করিলেন। শুধু দার্জিলিং নয়, সিকিমের ভূমিপুত্রও এই লেপচারাই। নেপালের ইল্লম জেলা এবং ভুটানের বহু অঞ্চলেও তাঁহারা স্মরণাতীত কাল হইতেই বসবাস করিতেছেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ নীতি এবং ভারত-নেপাল চুক্তির দৌলতে নেপাল হইতে অভিবাসীদের অবিরল স্রোত ক্রমশ তাঁহাদের নিজভূমে পরবাসী করিয়া পড়েন। পরবাসী এবং সংখ্যালঘুও। গোর্খারা আত্মপরিচয়ের রাজনীতি অনুশীলনে তৎপর হইলে লেপচাদের আত্মপরিচয় তাহার অন্তরালে হারাইয়া যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লেপচাদের ভূমিপুত্রের সম্মান ফিরাইয়া দিয়া তাঁহাদের আত্মমর্যাদা ও অধিকার উভয়ই পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী।
মুখ্যমন্ত্রী লেপচাদের স্বতন্ত্র উন্নয়ন পর্ষৎ গঠন করিয়াছিলেন। এ বার কালিম্পঙে গিয়া তিনি ওই পর্ষদের বরাদ্দ বাড়াইয়াছেন, তাহার ভবনের জন্য জমি দিয়াছেন, গৃহহীনদের জন্য ঘর, বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান, হস্তশিল্প বিপণন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রাথমিক শিক্ষায় লেপচা ভাষাকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার এবং লেপচা সংস্কৃতির অবলুপ্তি রোধ করিতে এক গুচ্ছ প্রস্তাব ইত্যাদি অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করিয়াছেন। লেপচাদের জন্য ইতিপূর্বে আর কোনও বঙ্গীয় রাজনীতিক এতটা ভাবেন নাই। জনদরদের বিজ্ঞাপনে পঞ্চমুখ বামফ্রন্ট সরকারের রথী-মহারথীরাও নহেন। স্বভাবতই, বিমল গুরুঙ্গরা ইহাতে মুখ্যমন্ত্রীর উপর রুষ্ট হইলেও লেপচারা কৃতজ্ঞ। নিন্দুকরা বলিবে, মমতার এই অবস্থান নিছকই রাজনৈতিক কৌশল, যাহার দ্বারা তিনি পার্বত্য দার্জিলিঙের এক জনগোষ্ঠীকে অন্য জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়া দিয়া গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার আন্দোলনে বিভাজন আনিতেছেন। যদি তাহা সত্য হয়, তবে প্রতিযুক্তি হইতে পারে পশ্চিমবঙ্গ হইতে দার্জিলিঙের আলাদা রাজ্য হওয়ার আন্দোলনের মোকাবিলা করিতে এই কৌশল একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যাহা তাঁহার পূর্বসূরিদেরও করা উচিত ছিল। কলিকাতা কিংবা শিলিগুড়িতে বসিয়া অন্তঃসারশূন্য রণহুঙ্কার ঘোষণা অপেক্ষা লেপচাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার কৌশলে গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের আন্দোলনকে দুর্বল করা সমগ্র রাজ্যের স্বার্থের পক্ষে অনেক বেশি ইতিবাচক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপকে ‘বিভাজন এবং শাসন’-এর ছকে দেখিতেই হইবে, এমন কোনও কথাও নাই। তাঁহার উদ্যোগ এক অর্থে অনগ্রসর একটি গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগও বটে, যাহা লেপচাদের উন্নয়নে সহায়ক হইবে। পার্বত্য দার্জিলিং রাজ্যের অবশিষ্ট অংশের তুলনায় পশ্চাৎপদ, সন্দেহ নাই। অনুন্নয়নের সমস্যাই সেখানে পৃথক রাজ্যের দাবিতে ইন্ধন জোগাইয়াছে। কিন্তু অনুন্নত দার্জিলিঙেও আবার লেপচাদের অবস্থা বিশেষ পশ্চাৎপদ। সংখ্যাল্পতার জন্য তাঁহারা গুরুঙ্গদের নির্দেশ অগ্রাহ্যও করিতে পারেন না। দারিদ্র, স্বাস্থ্যহীনতা, অশিক্ষা, বেরোজগারি তাঁহাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করিয়াছে। স্বশাসিত গোর্খা পার্বত্য পরিষদ কিংবা সাম্প্রতিক গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসন (জি টি এ), কেহই লেপচাদের উন্নয়নকে নিজ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে নাই। এই জনগোষ্ঠীর প্রতি রাজ্য সরকারের দায় থাকিয়াই যায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিংবা জ্যোতি বসু সেই দায় এড়াইয়া গিয়াছেন। আজ যে লেপচারা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে অভিবাদন জানাইতেছেন, তাহার মধ্যে কেবল রাজনীতি দেখিলে তাঁহাদের আত্মপরিচয়ের মর্যাদাকে অস্বীকার করা হয়। |