২২০ বছরের প্রাচীন সেন্ট জনস গির্জাকে রাজ্যের অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায় সরকার। এ বিষয়ে মূলত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহেই জরুরি পরিকল্পনা ও পর্যায়ক্রমে তার রূপায়ণ শুরু হয়েছে। পরিকল্পনা কী ভাবে এগোবে তা ঠিক করতে গির্জা-কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্য সরকারের সাত সদস্যের একটি কমিটি তৈরি হয়েছে।
রাজভবনের উত্তর-পশ্চিম কোণে শোভাবাজারের রাজপরিবারের দান করা জমিতে তৈরি হয় এই গির্জা। বিখ্যাত স্থপতি জেমস আগ লন্ডনের সেন্ট মাফিন-ইন-দি-ফিল্ডের আদলে তৈরি করেন প্রস্তাবিত গির্জার নকশা। তৎকালীন বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮৪ সালের ৬ এপ্রিল এর শিলান্যাস করেন। ১৭৮৭ সালে গির্জাটির কাজ শেষ হয়।
কী ভাবে হবে প্রাচীন এই গির্জার সংস্কার? গির্জার সূত্রে খবর, ব্রিটিশ রাজপুরুষ ও তাঁদের স্ত্রী-দের সমাধি-সহ গোটা গির্জারই সংস্কার হবে। বিশালাকার এই গির্জাভবনের চূড়া তৈরি হয়েছিল পাথরের টালি বসিয়ে। কিছু অংশে সে সব খুলে গিয়েছে। ছাদের কিছু অংশ থেকে চুঁইয়ে জল পড়ে। সে সবের সারাই হবে। গির্জার ঘণ্টার নাগাল পেতে কাঠের সিঁড়ি ছিল, তা ভেঙে গিয়েছে। তৈরি হবে ঠিক সেই আদলের সিঁড়ি। বসবে তিনটি ফোয়ারা। আলোকসজ্জা এবং নিকাশির ব্যবস্থাও হবে। পর্যটন সচিব বিক্রম সেন জানান, সংস্কারের জন্য সরকার চার কোটি টাকা বরাদ্দ করবে। |
জন জেফানির আঁকা ‘লাস্ট সাপার’। ছবি: ফাইল চিত্র |
সাত সদস্যের কমিটি-র অন্যতম, গির্জার রেভারেন্ড প্রদীপ নন্দা প্রায় ৪০টি দুষ্প্রাপ্য ছবি দেখিয়ে বলেন, “ইতিমধ্যে আমাদের অনুরোধে ‘ইনটাক’-এর বিশেষজ্ঞেরা এগুলো সংরক্ষণ করেছেন।” গির্জার দুষ্প্রাপ্য ছবির তালিকায় রয়েছে জন জেফানির তৈলচিত্র ‘লাস্ট সাপার’। গির্জার দ্বারোদ্ঘাটনের সময়ে জেফানি ছবিটি উপহার দেন। প্রদীপবাবু বলেন, “ওঁর এ রকম আঁকা আর একটিই আছে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।” তাঁর দাবি, গির্জার তত্ত্বাবধানেই সংস্কারের কাজ হবে।
গির্জার বহিরাবরণ ঘষে আসল রংটা বার করা হবে। তার উপরে একই রঙের প্রলেপ দেওয়া হবে। মেক্সিকো থেকে আনা ঘাস লাগানো হবে। কমিটির অন্যতম সদস্য, পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ার কনকেন্দু সিংহ বলেন, “ছ’টি পর্যায়ে হবে সংস্কারের কাজ। বছরখানেক সময় লাগবে।”
সেন্ট জনস গির্জায় রয়েছে জার্মানিতে তৈরি একটি প্রাচীন অর্গ্যান। সেটি রক্ষণাবেক্ষণেই ফি বছর প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। এ কথা জানিয়ে প্রদীপ নন্দা বলেন, “এ রকম অর্গ্যান এখন হাতে গোনা। এ ছাড়া, গির্জার ঘড়িঘরের সিঁড়ি ভেঙে যাওয়ায় বেশ কিছুকাল প্রাচীন ঘড়িটিতে দম দেওয়া যাচ্ছিল না। এখন সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।” আগে জোয়ার-ভাটায় গঙ্গার জল উপচে আসত এখানে। প্রদীপবাবু জানান, “গির্জার ভিতের নিচে প্রায় তিন ফুট বাঁধানো অংশ ছিল সেই জল রাখার জন্য। পরবর্তীকালে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন সেই অংশটি আবার খুলে দেওয়া হবে।”
সেন্ট জন্স গির্জায় চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন সস্ত্রীক জোব চার্নক। তাঁর আট কোণা সমাধিসৌধ তৈরি করান জামাই চার্লস আয়ার। চেন্নাইয়ের পান্নাভরম থেকে আনা হয়েছিল তার পাথর। এই দুই সমাধি ছাড়া সংস্কার হবে ফ্রান্সিস (বেগম) জনসনের সমাধি। বেগম ১৭২৫ থেকে ১৮১২ সাল পর্যন্ত ‘গ্র্যান্ড ওল্ড লেডি অফ ক্যালকাটা’ নামে পরিচিত ছিলেন।
শোনা যায়, নবাব সিরাজদৌল্লা কলকাতায় হানা দিয়ে ১৪৬ জন ইংরেজকে ১৪/৮ মাপের একটি ঘরে আটকে রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১২৩ জন বন্দি নাকি মারা যান। জীবিত বন্দিদের অন্যতম জন হলওয়েল প্রয়াতদের স্মরণে ওই জায়গায় (বর্তমানে যেখানে জিপিও ভবন) একটি স্মারক তৈরি করান। লর্ড কার্জন ১৯০১ সালে সেটিকে সরিয়ে আনেন রাইটার্স বিল্ডিংসের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। ১৯৪০ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁচ দেখে ব্রিটিশরা সেই সৌধ সরিয়ে আনেন সেন্ট জন্স গির্জা চত্বরে।
সেই সৌধটির সংস্কার হবে। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের উপজাতি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অযোধ্যার নবাবের যুদ্ধে (১৭৭২-১৭৭৪) মৃত ব্রিটিশ সেনাদের স্মৃতিতে তৈরি ১২টি স্তম্ভের গোলাকৃতি রোহিঙ্গা সৌধেরও সংস্কার হবে। |