তিনি জাদুকর নন। অথচ তাঁরই হাতের ছোঁয়ায় ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরবে বলে মনে করছে শিল্প ও শেয়ার বাজার মহল। যদিও রঘুরাম রাজন নতুন গভর্নর হিসাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাল ধরলেই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, এটা মনে করা নেহাতই কাকতালীয় বলেও তারা ইঙ্গিত দিয়েছে।
বুধবারই বিদায়ী গভর্নর ডি সুব্বারাওয়ের জায়গায় ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২৩তম কর্ণধারের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল রঘুরাম রাজনের। সেই মতোই এ দিন মিন্ট রোডে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সদর দফতরে পা রাখেন ৫০ বছরের রাজন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুল অফ বিজনেসের অধ্যাপক এবং আইএমএফ-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদের দায়িত্ব যিনি পালন করেছেন, শীর্ষ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসেবে তাঁর চেয়ে ‘যোগ্য লোক আর কে-ই বা হতে পারেন’ বলে মন্তব্য করেন তাঁর পূর্বসূরি সুব্বারাও। গত এক বছর তিনি ছিলেন অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টা।
রাজনের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব নেওয়ার পর্ব বিকেলে শুরুর আগেই এ দিন বন্ধ হয়ে যায় শেয়ার ও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার। অর্থনীতি, বিশেষত টাকার হাল ফেরাতে তাঁর ঘোষিত নয়া পথনির্দেশ (তাঁর কথায় ‘বিগ ইনিশিয়াল প্যাকেজ’) তাই বুধবার প্রভাব ফেলতে পারেনি বাজারে। তবে বাজার সূত্রে খবর, এ দিন রাজনের দায়িত্ব গ্রহণ যেহেতু নির্ধারিতই ছিল, সেই কারণে তাঁর উপর আস্থা রেখেই এক ধাক্কায় ৫৬ পয়সা বেড়েছে ডলারে টাকার দাম। দিনের শেষে প্রতি ডলারের দর দাঁড়ায় ৬৭.০৭ টাকা। সেনসেক্সও দিনের শেষে বাড়ে ৩৩৩ পয়েন্ট। থিতু হয় ১৮,৫৬৭.৫৫ পয়েন্টে। এক দিনে লগ্নিকারীদের পকেটে ঢোকে বাড়তি ১ লক্ষ কোটি টাকা।
এ দিন বাজার ওঠার পিছনে অবশ্য আন্তর্জাতিক কারণও ছিল। সিরিয়ায় দু’টি ক্ষেপণাস্ত্র হানার যে-খবর মঙ্গলবার রটে, তা ঠিক নয় বলে এ দিন জানা যায়। ইজরায়েল ও আমেরিকার যৌথ অস্ত্র মহড়ার ফলে সেগুলি ভূমধ্যসাগরে দেখা গিয়েছিল, এ খবরে আশ্বস্ত হয় বিশ্ব বাজার। যার জের এসে পড়ে ভারতেও। |
বিদায়ী ও নতুন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২৩তম গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব
নেওয়ার দিনে ডি সুব্বারাওয়ের সঙ্গে রঘুরাম রাজন (বাঁ দিকে)। |
তবে বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি বড় অংশ টাকায় লেনদেনের যে-প্রস্তাব রাজন দিয়েছেন, তাতে ভারতীয় মুদ্রার বিশ্বায়ন ঘটলে টাকার দামে স্থিতি ফেরানো যাবে বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে আশাবাদী শিল্প ও শেয়ার বাজার মহলও। যদিও কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাক্তন ডিরেক্টর এস কে কৌশিক এ দিন বলেন, “নতুন গভর্নর এলেই বাজার উঠবে, এমন আশা অর্থহীন। তবে তাঁর নীতি অর্থনীতিকে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায় কি না, সে দিকে নজর রাখছি।” তাঁর মতে আগে সেই বদল আসুক, তা না-হলে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। প্রবীণ বাজার বিশেষজ্ঞ অজিত দে বলেন, “নতুন গভর্নর আসার দিনে সূচকের ওঠা কাকতালীয়। ঠিক যেমন, গত কাল তা ৬৫১ পয়েন্ট পড়ারও তেমন কারণ ছিল না। আসলে বাজারে ফাটকা কারবার চলছে বেশি। তা বেয়ার-দেরই দখলে।” সাধারণ ভাবে অবশ্য রাজনকে ঘিরে আশাবাদী শেয়ার ও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার। বৃহস্পতিবার যার প্রভাব দেখা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
শিল্পমহল প্রত্যাশা মতোই রাজনকে স্বাগত জানিয়ে তাঁর কাছে সুদ কমানোর দাবি করেছে। সিআইআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আরবিআই এখন জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও রাজন হাল ধরতে সক্ষম।” অ্যাসোচ্যাম প্রেসিডেন্ট রানা কপূর বলেন, “পরিস্থিতি অনুকূল হলেই রাজন সুদ কমাবেন ও মূল্যবৃদ্ধিকে বাগে আনবেন।” ফিকি সেক্রেটারি জেনারেল দিদার সিংহ বলেন, “রাজনকে অনেক কাজ একসঙ্গে করতে হবে। যেমন: লগ্নিতে উৎসাহ দিয়ে বৃদ্ধির সড়কে ফেরা, টাকার পতন ঠেকানো, মূল্যবৃদ্ধি বাগে রাখা ইত্যাদি।” এই কঠিন অবস্থা থেকে রাজন অর্থনীতিকে বার করে আনতে পারবেন বলেই ভরসা তাঁদের। |
মাছের চোখ টাকার বিশ্বায়ন |
লক্ষ্য |
• কাজের স্বচ্ছতা • আগাম আন্দাজ করার মতো নীতি • বৈদেশিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশ টাকায় লেনদেনের ব্যবস্থা। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রার বিশ্বায়ন। এ জন্য ধাপে ধাপে আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার • জানুয়ারি নাগাদ নয়া ব্যাঙ্ক লাইসেন্স • আধার কার্ডের হাত ধরে প্রত্যন্ত গ্রামেও ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা • মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের প্রসার • ব্যাঙ্কের ঘাড় থেকে সব রকম ঋণের দায় কমানো। এ জন্য অন্য আর্থিক সংস্থাকে আরও বেশি অধিকার • দেশের বাজারে বিদেশি ব্যাঙ্কের আরও বড় ভূমিকা • আরও মজবুত আর্থিক পরিকাঠামো • লাভজনক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণের পথ প্রশস্ত করা |
প্রাথমিক পদক্ষেপ |
ঋণ ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থায় জোর • সরকারি ঋণপত্র কিনতে ব্যাঙ্কের দায় কমানো • সাধারণ মানুষের জন্য ইনফ্লেশন-ইনডেক্সড বন্ড। এই সব ঋণপত্রের রিটার্ন নির্ভর করবে মূল্যবৃদ্ধির হারের উপর • ব্যাঙ্কিং লাইসেন্সের আবেদন খতিয়ে দেখতে ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর বিমল জালানের নেতৃত্বে কমিটি |
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যে কোনও গভর্নরই
কাজ শুরু করেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকে।
কিন্তু কিছু সিদ্ধান্ত
আমাকে নিতেই হবে, যা আদৌ জনপ্রিয় হবে না। ভোটে জেতা বা ফেসবুকে ‘লাইক’ পাওয়া গভর্নরের কাজ নয়। রঘুরাম রাজন |
|
বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের কাছ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নিয়ে তা সংস্থার সাধারণ খরচের জন্য ব্যবহার করা যাবে। পাশাপাশি, কোনও সংস্থা তার নিট সম্পদের ৪০০% পর্যন্ত বিদেশে লগ্নি করতে পারবে। ওই তহবিল সংগ্রহ করতে হবে বৈদেশিক ঋণ বাবদ। গত মাসে তা ১০০% করা হয়, যা এ বার শিথিল করা হল। |