স্কুলেই রয়েছে একটা আস্ত মিউজিয়াম। তাতে আছে নানা ধরনের ধান, ফসিল, সয়েল টেস্টিং ল্যাব, দুর্লভ পাথর, মুদ্রা, মনিষীদের ছবি। চব্বিশটা কম্পিউটার নিয়ে একটা কম্পিউটার ল্যাবও আছে। শেখার ফি মাসে চার টাকা। আছে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির আলাদা ল্যাবরেটরি। বারোটি প্রজাতির উপকারী গাছ নিয়ে ভেষজ উদ্যান। তিরানব্বই ফুট লম্বা অডিটোরিয়াম, বসতে পারে প্রায় ৫০০ ছেলেমেয়ে। মাসে একটা শনিবার দেখানো হয় শিক্ষামূলক ফিল্ম।
দেড় লক্ষ টাকা ফি-এর কলকাত্তাইয়া ইস্কুল নয়। নয় দুর্গাপুর বা দার্জিলিঙের ‘কনভেন্ট’ স্কুল। এ হল বীরভূমের দুবরাজপুর ব্লকের চিনপাই হাইস্কুল। সেখানে পড়াশোনা করে ১৯৫২ ছেলেমেয়ে, তাদের অধিকাংশই বেশ গরিব পরিবারের। সংখ্যালঘু, দলিত-আদিবাসী পড়ুয়ার অংশটা বেশ বড়। কিন্তু তাদের স্কুল তাদের এমন অনেক সুযোগ-সুবিধে দিচ্ছে, যা অনেক নামীদামী স্কুলের ছাত্রদেরও জোটে না।
যেমন, মেয়েদের ওঠা-নামার জন্য আলাদা ব্যবস্থা। প্রধান শিক্ষক বিদ্যুৎ মজুমদার বলেন, “আমরা লক্ষ করেছি, সিঁড়ি দিয়ে ছেয়ে-মেয়েরা ওঠা-নামার সময়ে মেয়েদের বিরক্ত করার ঘটনা ঘটে বেশি। তা আটকানো মুশকিল। তাই মেয়েদের জন্য আলাদা র্যাম্প করে দিয়েছি।” ছেলেদের জন্য সিঁড়ি, মেয়েদের র্যাম্প। তার বাড়তি সুবিধে, আগুন লাগলে দ্রুত খালি করা যাবে স্কুল। |
পড়ুয়াদের অন্য নানা অসুবিধের দিকেও সজাগ বিদ্যুৎবাবু। ‘‘মেঝেতে বসে খেতে গেলে থালায় ধুলো উড়ে আসে, গায়ে ঝোল পড়ে। তাই ডাইনিং রুম তৈরি করেছি। সেখানে বুফে সিস্টেম-এ খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে খাবার মতো টেবিল রয়েছে।” ছাত্রীদের জন্য একটা রেস্টরুমও রয়েছে তিনতলা স্কুলের দোতলায়।
স্কুলের মাটির তলাতেও রয়েছে চমক— ১৭ হাজার বর্গফুটের আন্ডারগ্রাউন্ড জলাধার। “এ বার বর্ষায় এক লক্ষ লিটার জল ধরা গিয়েছে,” বললেন বিদ্যুৎবাবু। ওই জল দিয়ে বাথরুমের কাজ, মিড ডে মিলের পর হাত ধোয়ার কাজ তো হচ্ছেই, সেই জল ফিল্টার করে খাবার জলের চাহিদাও মিটছে। স্কুল ভবন তৈরির কাজেও লেগেছে ওই জল।
কী করে সম্ভব হচ্ছে এত কিছু? কোনও ধনী পৃষ্ঠপোষকের বদান্যতায় নয়, স্রেফ সরকারি টাকায়। তার মধ্যে শিক্ষা দফতরের টাকা ছাড়াও রয়েছে সাংসদের এলাকা উন্নয়নের অনুদান। বিদ্যুৎবাবুর দাবি, ঠিক মতো খরচ করলে সরকারি টাকা কম হয় না, বরং কিছু বেশিই হয়। “মিড ডে মিলের বরাদ্দ থেকে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা সরকারকে ফিরিয়ে দিয়েছি। বছর দুয়েকে জমা হয়েছিল টাকাটা।” কিছু ছেলেমেয়ে স্কুলে খায় না, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময়েও কম ছেলেমেয়ে খায়। পরিবেশনকারীদের অ্যাপ্রন, গ্লাভস সব জোগানোর পরেও বাড়তি টাকা থেকে যাওয়ায় তা ফেরত দেওয়া হয়েছে সরকারকে।
বিদ্যুৎবাবুর দাবি, তিনি কেবল সরকারি নিয়ম মেনে কাজ করে যাচ্ছেন। রোজ সকাল ৯ টা থেকে ৫.৩০ টা স্কুলে থাকেন। তাঁর সঙ্গে সারাদিন স্কুলের জন্য কাজ করেন তাঁর সহকর্মী শিক্ষকরাও। স্রেফ সরকারি টাকায়, সরকারি নিয়মে, সরকারি স্কুলে সরকারি শিক্ষক কী করতে পারেন, তার নিদর্শন চিনপাই। |