দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন বড়সড় একটা গ্রাম। গ্রামই বটে। শুধু মানুষগুলোই যা উবে গিয়েছে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বিশাল বিশাল বাড়ির সব কাঠামো। কারও ছাদটা উড়ে গিয়েছে। কারও আবার হেলে পড়েছে এক দিকের দেওয়াল। দরজা-জানলার জায়গা রয়েছে, তবে পাল্লাগুলোই যা নেই। ৭০ বছর ধরে এ রকম কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ফ্রান্সের ভুতুড়ে গ্রাম ওরাদ্যুর-স্যুর-গ্লান। বুকে দগদগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত।
১৯৪৪ সালের ১০ জুন কর্মব্যস্ত এই ফরাসি গ্রামটাকে চোখের পলকে শ্মশান বানিয়ে দিয়েছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনী। গ্রেনেড আর বন্দুকের নলের সামনে পরে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় সাড়ে ছ’শো মানুষ। যার মধ্যে ছিল দু’শোরও বেশি শিশু।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্যুয়েরার হিটলারের এই কীর্তির কাছেই এত যুগ পর ফিরে গেলেন জার্মানিরই প্রেসিডেন্ট। তবে তছনছ করতে নয়, স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে নিয়েই দু’দণ্ড দাঁড়াতে। বীভৎসতা দেখে শিউরে উঠতে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের সঙ্গে আজ ওরাদ্যুর গিয়েছিলেন জার্মান প্রেসিডেন্ট জোয়াখিম গাউক। নাৎসি জার্মানির তাণ্ডবের শিকার এমন শহরে এই প্রথম কোনও জার্মান রাষ্ট্রনেতা এলেন। |
ভুতুড়ে গ্রামে জার্মান প্রেসিডেন্ট জোয়াখিম গাউক(বাঁ দিক থেকে তৃতীয়)। বুধবার। ছবি: এপি। |
নিজেরই দেশের ধ্বংসলীলার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন লাগল, প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত যেন বিহ্বল জোয়াখিম। তার পর বললেন, “এখানে আসতে পেরে আমি সম্মানিত। তবে যে অতীতের সামনে আমি দাঁড়িয়ে, তা থেকে বহু পথ পেরিয়ে এসেছে আজকের জার্মানি।” “মনের মধ্যে এত দিন যেন পাথর চেপে বসেছিল। ছোট বেলা থেকেই ঘেন্না করতে শিখেছিলাম জার্মানদের” বললেন রবার্ট হেব্রাস। নাৎসি আক্রমণের দিন গোটা গ্রামে বেঁচে গিয়েছিলেন তিন জন। তাদেরই এক জন রবার্ট। সে দিনের উনিশ বছরের কিশোর আজ অশীতিপর বৃদ্ধ। কিন্তু অভিশপ্ত দিনটার স্মৃতিতে চিড় ধরেনি এতটুকু। তাঁর কথায়, “হাড়গোড়ের তলায় কোনও ভাবে ঢাকা পড়ে গিয়েছিলাম। তাই বেঁচে আছি, ওরা ধরতেই পারেনি।”
স্মৃতি হাতড়ে বলে চললেন, গ্রামের মেয়েদের ওরা গির্জায় নিয়ে গেল। মায়েদের পিছু পিছু গিয়েছিল ছোটরাও। সবাইকে সেখানে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে গ্রেনেড ছুড়ে নাৎসিরা পুড়িয়ে দিয়েছিল গির্জাটা। আর ছোট-বড় সব পুরুষকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চাষের খেতে। তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল সারি সারি মেশিনগান। সবাই জড়ো হতেই নির্বিচারে শুরু হয়েছিল গুলিবৃষ্টি।
হিটলার আক্রমণের জন্য ওরাদ্যুরকে কেন বেছে নিয়েছিলেন, তা নিয়ে অবশ্য মত অনেক। সোনা লুঠ করতেই এই হামলা, মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞই। আবার এক দলের মত, হিটলারের যে বাহিনী এই গ্রাম আক্রমণের দায়িত্বে ছিল, তাদের বহু সেনাই ছিল আলসেস অঞ্চলের বাসিন্দা। ফ্রান্স ও জার্মানির সীমান্ত এই অঞ্চল রাজনীতির ফেরে দুই দেশের মধ্যে হাতবদল হয়েছে বহু বার। সেই গোপন রাগও ওরাদ্যুর-স্যুর-গ্লান হামলায় মদত জুগিয়ে ছিল বলে বিশ্বাস করেন অনেকে।
সাত দশকের ইতিহাস ভুলে আজকের মতোই কাছাকাছি আসতে চায় ফ্রান্স আর জামার্নি দুই দেশই। জার্মান প্রেসিডেন্ট গ্রামে আসায় এত দিনে যেন তৃপ্ত রবার্ট। ওদের সঙ্গে এ বার এক পথে হাঁটাই যায়, স্বগতোক্তির ঢঙেই বললেন ওই বৃদ্ধ। |