আড়ালে বসে চারায় জল ঢেলে চলেছেন হেডস্যার
তিনি সোনা চেনেন। হাতে পেলে গড়ে-পিটে গয়নাও বানিয়ে ফেলেন।
দুর্গাপুর শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অযোধ্যা গ্রামে বসে আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে দুঃস্থ কিন্তু মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের খুঁজছেন এক হেডস্যার। শুধু খুঁজে বেরই করছেন না, নিজের কাছে এনে লালনপালন করছেন। উতরে দিচ্ছেন কঠিন পরীক্ষায়।
প্রথম শ্রেণি ইস্তক তাঁর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেই এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে দুর্গাপুর মহকুমার অন্যতম সেরা হয়েছে এক পড়ুয়া। তিনি, কাঁকসা জঙ্গলমহলের সাতকাহানিয়া প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
আদিবাসী-প্রধান জঙ্গলমহলে বহু পরিবারেরই বেশি দূর ছেলেমেয়ের পড়াশোনা খরচ জোগানোর সামর্থ্য নেই অধিকাংশ পরিবারের। প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করার সুবাদে প্রতিনিয়তই এমন পড়ুয়াদের সম্মুখীন হতে হয় রামপ্রসাদবাবুকে।
আলিনগরের আদিবাসীপাড়ার মনিকা বেসরার পড়া যেমন থমকে গিয়েছিল অষ্টম শ্রেণিতে। রামপ্রসাদবাবু তাকে পড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। পুরনো একটি সাইকেলেরও ব্যবস্থা করে দিলেন। তাতে চেপে তাঁর বাড়িতে এসে সে পড়ে যেত। সম্প্রতি বোলপুর কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছে মনিকা। এক দিন হেডস্যারের কাছে পড়েই অমরপুরের ফাল্গুনী দে এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। সুনীল মাড্ডি চাকরি করে পুলিশ বিভাগে। আলিনগরের আদিবাসীপাড়ার শোভা মুর্মু প্রাথমিক শিক্ষক। বৈশাখী বাগদি, মমতা বাগদি নার্সিং প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে ব্যস্ত রামপ্রসাদবাবু। —নিজস্ব চিত্র।
অযোধ্যা গ্রামের মণিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “দীর্ঘদিন ওঁকে কাছ থেকে দেখছি। কত জন যে এল! উনি বিনা পয়সায় পড়ান। বই, খাতা, কলম কিনে দেন। স্কুলের ফি দিয়ে দেন। এক জনকে সাইকেলও কিনে দিয়েছেন।” এক বার অযোধ্যা হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন রামপ্রসাদবাবু। দেখেন, সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়াডাঙালের সুকুমার টুডুর বিজ্ঞানের ফল দারুণ। কিন্তু ভূগোল-সহ কলা বিভাগের বিষয়গুলির অবস্থা করুণ। তার বাড়িতে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে সুকুমারকে বাড়িতে আসতে বলেন তিনি। রামপ্রসাদবাবুর কথায়, “প্রথম দিন এসেছিল পকেট ভর্তি খেজুর, জাম আর গুলতি নিয়ে। সেই ছেলে মাধ্যমিকে ভুগোলে ৮৬ পেয়েছিল। এখন গুসকরার একটি হাইস্কুলের ভুগোলের শিক্ষক।”
হেডস্যার সবচেয়ে মজা পেয়েছিলেন বনগ্রামের শুভম পাতরকে নিয়ে। প্রথম শ্রেণির শুভম শারীরিক ভাবে দুর্বল ছিল। সহপাঠীদের সঙ্গে পেরে উঠত না। প্রায়ই দ্বিতীয় শ্রেণির ঘরে এসে শিক্ষকের টেবিলের তলায় লুকিয়ে থাকত সে। এক দিন ক্লাস নিতে এসে চেয়ারে বসতেই রামপ্রসাদবাবুর পা লাগে শুভমের গায়ে। তাকে টেবিলের নীচ থেকে বের প্রথম শ্রেণির ঘরে চলে যেতে বলেন তিনি। কিন্তু সে কিছুতেই যাবে না! উল্টে দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়াদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে সে আগ বাড়িয়ে উত্তর দিয়ে দেয়। রামপ্রসাদবাবুর ভাল লেগে গেল ছেলেটিকে। শুভমের ভাল লেগেছিল আরও বেশি। স্কুল ছুটির পরে স্যার দেখেন, ছোট্ট ছাত্র তাঁর মোটরবাইকের পিছনে চড়ে বসেছে। নামানো যায় না!
সেই বাইকে চেপেই রামপ্রসাদবাবুর বাড়িতে চলে এল শুভম। পিছন-পিছন তার জনমজুর বাবা বনমালী পাতরও এসেছিলেন সাইকেলে চড়ে। কিন্তু শুভম ফেরেনি। তার পর থেকে সে বড় হয়েছে রামপ্রসাদবাবুর বাড়িতেই। এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগে ৪৫৬ নম্বর পেয়ে দুর্গাপুর মহকুমায় অন্যতম সেরা হয়েছে সে। বর্তমানে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের পড়ুয়া শুভম জানায়, এখনও ছুটি পেলে সে নিজের বাড়িতে নয়, স্যারের বাড়িতেই ফেরে।
রামপ্রসাদবাবুর এ হেন কর্মকাণ্ডে বরাবরই পাশে থেকেছেন তাঁর স্ত্রী মিনতিদেবী। মৃদু হেসে তিনি বলেন, “ওঁর জন্য আমার গর্ব হয়।” রামপ্রসাদবাবু অবশ্য কোনও কৃতিত্ব নিতে নারাজ। তাঁর মতে, ‘‘আমি বেশি কিছু করিনি। ওরা প্রত্যকেই ছিল সোনা। আমি শুধু সেই সোনা দিয়ে গয়না বানিয়েছি।” নিজে নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেন। এলাকায় কবি পরিচিতিও আছে। বছর দু’য়েক চাকরি এখনও বাকি। কিন্তু তাঁর আসল নেশা সেই সোনার গয়না গড়া। আপাতত সংখ্যালঘু পরিবারের অষ্টম শ্রেণির চার মেয়েকে বেছে নিয়েছেন। তাঁর চ্যালেঞ্জ, তাদের মধ্যে অন্তত দু’জনকে মাধ্যমিকে চোখে পড়ার মতো ভাল ফল করানো।
শিক্ষক দিবসে আর পাঁচ জন শিক্ষক যখন পড়ুয়াদের থেকে বই, কলম, আরও নানা দামি উপহার পান, রামপ্রসাদবাবুর হাত ভরে ওঠে আম, পেয়ারা, পেঁপে, মহুয়া ফল, বনফুলে। সবই পড়ুয়াদের নিজের বাড়ি অথবা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে আনা। আর তিনি পড়ুয়াদের হাতে তুলে দেন পেয়ারা চারা। বলেন, “আপেলের মতো পুষ্টি পেয়ারায়। আপেলের খুব দাম। হাতের কাছে পেয়ারা থাকলে তবু তো ওরা খেতে পাবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.