|
|
|
|
হৃদরোগ বাড়ছে মেয়েদের, উদ্বিগ্ন চিকিৎসকেরা |
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
দু’টি তথ্য। আর দু’টিই একেবারে চমকে দেওয়ার মতো। গত পাঁচ বছরে মহিলাদের মধ্যে হৃদ্রোগের প্রকোপ বেড়ে গিয়েছে ৩০০ গুণ! আর এখন স্তন ক্যানসারে যত মহিলা মারা যাচ্ছেন, তার ছ’গুণেরও বেশি মহিলার মৃত্যু হচ্ছে হৃদ্রোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থা (হু)-র পেশ করা এই সাম্প্রতিক তথ্য ভাঁজ ফেলেছে এ দেশের স্বাস্থ্যকর্তাদের কপালেও। ভারত যে অচিরেই বিশ্বে হৃদ্রোগের ‘রাজধানী’ হয়ে উঠতে চলেছে, সে নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই আলোচনা চলছিল। কিন্তু এ বার মহিলাদের মধ্যে হৃদ্রোগের আক্রমণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ার তথ্য সামনে আসায় নিজেদের অনেকটাই প্রতিরোধহীন বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।
কেন? কারণ, সাধারণভাবে হৃদ্রোগ নিয়ে প্রচার হলেও মেয়েদের ব্যাপারে আলাদাভাবে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ হয়নি। বরং মেয়েদের ‘কল্জের জোর’ বেশি এই ধারণার বশবর্তী হয়েই নিশ্চিন্ত থেকে গিয়েছেন অনেকে। চিকিৎসকদের হুঁশিয়ারি, আগে ধরে নেওয়া হত যত দিন মেয়েরা প্রজননক্ষম থাকছেন, তত দিন হৃদ্রোগের ভয় নেই বললেই চলে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই ধারণাটা অনেকটাই ভুল। মেনোপজ-এর বহু আগেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। কখনও কখনও
তা এমনই যে এক ধাক্কায় প্রাণটাও চলে যাচ্ছে।
বেঙ্গালুরুর একটি হৃদরোগ চিকিৎসাকেন্দ্রের চেয়ারম্যান, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠীর কথায়, “৪৫-৫০ বছর বয়স পর্যন্ত মেয়েদের শরীর থেকে এমন কিছু হরমোন বার হয় যার দরুণ হার্টের সমস্যা সাধারণভাবে কম থাকার কথা।
|
|
উপসর্গ |
• বুকে ব্যথা, ঘাম হওয়া
• কাঁধে, হাতে ব্যথা
• পেটে চাপ
• হাঁটতে অসুবিধা
• ঘন ঘন হজমের গোলমাল
• একটানা ক্লান্তি, অবসাদ |
কী কী পরীক্ষা করবেন |
• ব্লাড প্রেশার
• ব্লাড সুগার
• লিপিড প্রোফাইল
• ইসিজি
• ইকোকার্ডিওগ্রাফি |
|
কিন্তু ইদানিং সেই তত্ত্ব বহু ক্ষেত্রেই উল্টে যাচ্ছে।”
কেন? বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর কারণ ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ এবং ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস। এই দুই অভ্যাস ওই সব হরমোনের সুপ্রভাবকে নষ্ট করে দেয়। গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট দীর্ঘদিন যাঁরা খান, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা দিতে পারে। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “এখন মেয়েদের ঘরে-বাইরে গুরুদায়িত্ব। কোনওটাকেই তারা অবহেলা করতে পারছে না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ধূমপান, মদ্যপান। এর উপরে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবিটিস থাকলে তো সোনায় সোহাগা।”
হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ অরুণাংশু গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “সংসার, সন্তান, চাকরি-এই তিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মেয়েদের ‘স্ট্রেস’ সাঙ্ঘাতিক বেড়ে যাচ্ছে। তারই পরিণাম এই হৃদ্রোগ। চেনা উপসর্গগুলো না থাকায় বহু ক্ষেত্রে তা প্রাণঘাতীও হয়ে উঠছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, বহু ক্ষেত্রেই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে যখন সেই মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে।”
মেয়েদের হৃদ্রোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ এখনও সে ভাবে শুরুই হয়নি। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছে এক বেসরকারি সংস্থা। সংস্থার তরফে স্বদীপ শ্রীবাস্তব বলেন, “কাজটা করতে গিয়ে আমাদের যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এখন মেয়েদের শিক্ষা, তাদের পেশাগত জগৎ আগের থেকে গুরুত্ব পাচ্ছে, কিন্তু স্বাস্থ্যের দিকটা অত্যন্ত অবহেলিত। পরিবারের কাছে, এমনকী মেয়েটির নিজের কাছেও।”
এর সঙ্গে রয়েছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় বসে কাজ করা এবং ন্যূনতম শরীরচর্চাটুকুও না করার অভ্যাস। কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসু জানালেন, কিছু দিন আগেই তিনি ১৭ বছরের এক তরুণীর বাইপাস সার্জারি করেছেন। তাঁর কথায়, “বাবা মেয়েকে একটা কম্পিউটার কিনে দিয়েছিলেন। মেয়ে সব সময়ে কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু না কিছু করছে। আর প্যাকেটের পর প্যাকেট চিপস শেষ করছে। ফল যা হওয়ার তা-ই।”
খাদ্যাভ্যাসের উপরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। বিশেষত তেলের বিষয়টিতে। তৈলাক্ত খাবারের প্রতি মেয়েদের আকর্ষণ তুলনামূলক ভাবে বেশি হওয়ার কারণেও মেয়েদের হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে যায় বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। দিল্লির একটি হার্ট ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান অশোক শেঠ বলেন, “তেল হল হৃৎপিণ্ডের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই রান্নার তেল বেছে নেওয়ার ব্যাপারটা সবচেয়ে জরুরি। যে সব তেলে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে, সেই তেল ট্রান্স-ফ্যাট বেশ খানিকটা কমিয়ে আনতে পারে।”
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বহু ক্ষেত্রে মেয়েদের হৃদ্রোগের তেমন উপসর্গ থাকে না। আবার থাকলেও অনেক সময়ে চেনা উপসর্গের পরিবর্তে কিছু অচেনা উপসর্গ থাকে। যেমন, ডায়াবিটিস থাকলে অনেক সময়ে বুকে ব্যথা টের পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বহু ক্ষেত্রেই বুকে ব্যথার বদলে পেটে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। এর ফলে অসুখটা আদতে কী তা টের পেতেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়।
সত্যজিৎ বসুর কথায়, “মেয়েদের ধমনীগুলো পুরুষের তুলনায় ছোট। তাই অস্ত্রোপচারের সুফল তুলনামূলক ভাবে কম। রোগ হওয়ার পরে চিকিৎসা না করে রোগ প্রতিরোধটাই তাই সবচেয়ে জরুরি। আগে আমরা ৪০ বছরের পর চেক আপ করানোর কথা বলতাম। এখন তো বলি ৩৫-এর পর থেকেই বছরে এক বার চেক আপ করিয়ে নিন। ডায়াবিটিস বা হাই ব্লাড প্রেশার থাকলে কিংবা বাড়িতে কারও হৃদরোগের ইতিহাস থাকলে তো অবশ্যই করানো উচিত।” |
|
|
|
|
|