গাড়িটার চাকা জমা জলে মুখ ঢেকে ফেলা রাস্তার গর্তে পড়তেই কাদাজল ছিটকে এসে লাগল এক পথচারীর জামাকাপড়ে। সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ কাজেই বেরিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। পথচলতি দু’একজন সহানুভূতি দেখাতেই একেবারে রুদ্রমূর্তি ভদ্রলোকের। তা দেখে ভাবলাম এ বার বোধহয় গাড়ির চালকের বাপান্ত করবেন। যদিও এর পরে যা ঘটল তা বোধহয় গোটা বসিরহাট পুর এলাকার বাসিন্দাদেরই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। দেখলাম চিৎকার করে ভদ্রলোক বলছেন, “গাড়ির চালকের আর দোষ কি। পুরসভা রাস্তা না সারালে ওরাই বা কী করবে? ট্যাক্স দিই, অথচ ন্যূনতম সুস্থভাবে যাতায়াতের সুবিধাটুকুও নেই। এরা আবার ভোট চায় কোন মুখে!”
বস্তুত, গোটা বসিরহাট মহকুমা জুড়েই বেহাল রাস্তাঘাট নিয়ে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। শহরের প্রধান চারটি রাস্তার অবস্থা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। কোথাও রাস্তা দেখে বোঝার উপায় নেই যে কোনওসময় পিচ পড়েছিল। কোথাও পুকুরে হাঁস চরার মতো জল জমে গিয়েছে। তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা গর্তে পড়ে শুধু যে পথচারীরাই হাত-পা ভাঙছেন তা নয়, ভাঙছে গাড়ির যন্ত্রাংশও। |
এলাকার মানুষের অভিযোগ, দিনের পর দিন এর প্রতিকার চাইতে চাইতে নাজেহাল। বিক্ষোভ, অবরোধ থেকে রাস্তা কেটে দেওয়া, কোনও কিছুতেই টনক নড়েনি প্রশাসনের। অতঃপর, বাধ্য হয়ে ভোগান্তিকেই মেনে নিতে হচ্ছে। তাঁদের আরও অভিযোগ, ভোট এলেই গদির লোভে নানা প্রতিশ্রুতিতে সব রাজনৈতিক দলই এক। তারপর জিতে যাওয়ার পরে সাধারণ মানুষ পুর-পরিষেবা ঠিকমতো পাচ্ছেন কি না তা নিয়ে তাঁদের ভাবার সময় থাকে না। আর সে জন্যই কি রাস্তাঘাট, কি নিকাশি সর্বত্রই পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ইছামতী নদী। তা সত্ত্বেও শহরে নিকাশি ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ায় বৃষ্টির জমা জলে দিনের পর দিন রাস্তা ডুবে আছে। এতে রাস্তারও ক্ষতি হচ্ছে।
বসিরহাট মহকুমা হাসপাতাল, বেলতলা, জামরুলতলা, শ্মশানঘাট, পুরাতন বাজার, থানা, বৌবাজার এবং ত্রিমোহিনী এলাকায় ইটিন্ডা রাস্তার অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে। মার্টিন বার্ন রোডে পূর্ণচন্দ্র গার্লস হাইস্কুলের কাছে, এস এন মজুমদার রোডে সাঁইপালা এলাকায়, হরিমোহন দালাল গার্লস হাইস্কুলের কাছে এবং টাকি রোডে ত্রিমোহিনী থেকে ফাল্গুনি হয়ে হরিশপুর এলাকায় রাস্তার অবস্থা রীতিমত বিপজ্জনক। ইটিন্ডা রাস্তার দু’পাশে কোনও নিকাশি নালা আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। ফলে বৃষ্টি হলেই জল থই থই। শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ছাড়াও এটি শহরের ব্যবসার অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা। এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, একে অপরিসর রাস্তা। তার উপর সেটাও জল জমে বেহাল হলেও ব্যবসায়ীদের তা নিয়ে সে ভাবে সরব হতে দেখা যায় না। ফলে যেখানে ভাল রকমের সংস্কার প্রয়োজন সেখানে শুধু পিচ-পাথরের বদলে ইট ফেলে, গর্ত বুজিয়ে, তাপ্পি মেরে দায়সারা ভাবে সংস্কার হয়। কমল মণ্ডল, প্রশান্ত জানা, অজয় বাইন বলেন, “রাস্তার সমস্যা নিয়ে বহু বার পুরপ্রধান, পূর্ত দফতরের দ্বারস্থ হয়েছি। কাজ যে হয়নি তা বলাইবাহুল্য। কেবল দুর্ঘটনা ঘটলে একটু হইচই হয়।’’ বিভিন্ন রাস্তার দু’পাশ দখল করে যত্রতত্র দোকানপাটও নিকাশি সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ। পাথুরিয়াঘাটা। চোঙারআটি, বদরতলা, কাটাখাল সংস্কারে কোনও পরিকল্পনা না হওয়ায় শহরের জল সরার প্রায় সব রাস্তাই বন্ধ। নিকাশি নালা ও খালগুলির সঙ্গে ইছামতী নদীর সংযোগ ঘটানো হলে নিকাশি সমস্যার অনেকটাই সুরাহা হবে বলে বাসিন্দাদের মত। কিন্তু সেই কাজ করবে কে? |
বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক নারায়ণ মুখোপাধ্যায় বলেন, “খাল সংস্কারের জন্য জেলা পরিষদ থেকে টাকা এলেও বর্ষার সময় খালপাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করতেই তা খরচ হয়ে যায়।” তৃণমূল নেতা পার্থসারথি বসু বলেন, “বত্রিশ বছর পুরসভার দায়িত্বে থেকেও বামেরা নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতির প্রয়োজন বলে মনেই করেনি।” জেলা কংগ্রেস নেতা বাবলি বসু বলেন, “রাস্তার পাশে নর্দমা না করলে জল সরবে কি করে? সীমান্ত-বাণিজ্য পরিবহণের জন্য পরিকাঠামোর ব্যবস্থা না করে যদি দশ টন ভার বহনে সক্ষম রাস্তার উপর দিয়ে ১০-১২ চাকার লরি চল্লিশ-পঞ্চাশ টন মাল নিয়ে যায়, তা হলে রাস্তার অবস্থা তো শোচনীয় হবেই।”
নিত্যযাত্রী কমলা মণ্ডল, রীতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রাস্তার যা হাল, তাতে বাসে উঠলে এমন দুলুনি খেতে হয় যে, অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসার জোগাড়! রাস্তার কারণে হাসপাতালে যাওয়ার সময় অসুস্থ মানুষ আরও অসুস্থ হন। অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। প্রবল ঝাঁকুনিতে অনেক প্রসূতির প্রসব হয়ে যায়। এ সব দেখেও লজ্জা হয় না নেতা-নেত্রী, প্রশাসনের কর্তাদের।
বসিরহাট পুরসভার কংগ্রেস চেয়ারম্যান কৃষ্ণা মজুমদার বলেন, “পুরসভার অধীনে থাকা দু’টো রাস্তা সংস্কারের জন্য ইতিমধ্যেই টেন্ডার হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির জন্য কাজ শুরু করতে দেরি হচ্ছে।” পূর্ত দফতরের বসিরহাট মহকুমার সহকারি বাস্তুকার তপন নস্কর বলেন, “রাস্তার নীচ দিয়ে যাওয়া পানীয় জলের পাইপ মেরামতি ও রাস্তার দু’পাশে দখলদারি সরিয়ে জল বের হওয়ার নর্দমা না করা পর্যন্ত রাস্তা ভাল থাকা সম্ভব নয়। পুর-কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার বলেও কাজ হয়নি। তবে বৃষ্টি একটু কমলে আপাতত চলাচলের সুবিধার্থে রাস্তা মেরামত করা হবে।”
|