মাইক্রোসফট মোহনাতেই মিশে গেল নোকিয়া।
মার্কিন সময় অনুযায়ী, সোমবার গভীর রাতে বিল গেটসের সংস্থা জানিয়ে দিল, নোকিয়ার মোবাইল তৈরির ব্যবসা কিনে নিচ্ছে তারা। ‘নোকিয়ানভির্তা’ নদীর থেকে নাম হওয়া ১৪৮ বছরের পুরনো এই ফিনিশ সংস্থাকে ঝুলিতে পুরতে ৭২০ কোটি ডলার (প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা) উপুড় করছে মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি বহুজাতিকটি। ফলে এক সময় মোবাইল হ্যান্ডসেট বাজারের প্রায় একচ্ছত্র অধিপতি নোকিয়াকে এখন ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তাকিয়ে থাকতে হবে মাইক্রোসফটের দিকেই।
ইন্টারনেটে মুখোমুখি বসে কথা বলার পরিষেবা স্কাইপ (৮৫০ কোটি ডলার) কেনা ছাড়া এর আগে কখনও কোনও সংস্থার জন্য এত টাকা খরচ করেনি মাইক্রোসফট। সংস্থার সিইও স্টিভ বামারের দাবি, “ভবিষ্যতের জন্য এটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এতে লাভ হবে দুই সংস্থারই।” কিন্তু বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, সত্যিই কি তাই? আদৌ এই সিদ্ধান্তের সুবাদে স্মার্ট ফোনের বাজার ধরতে পারবে মাইক্রোসফট (বা নোকিয়া)? বেগ দিতে পারবে অ্যাপল, স্যামসাং, গুগ্লের মতো বহু যোজন এগিয়ে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বীকে? নাকি সেই দূরত্ব ক্রমশই বাড়বে? ব্যর্থ প্রতিপন্ন হবে এই মাইলফলক চুক্তিও? |
মাইক্রোসফট সিইও স্টিভ বামারের সঙ্গে নোকিয়ার সিইও স্টিফেন ইলোপ (বাঁ দিকে)। ছবি: রয়টার্স |
বামারের ঘোষণা তথ্যপ্রযুক্তির বাজারে যেমন একগুচ্ছ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, তেমনই তৈরি করেছে জল্পনা। অনেকেই বলছেন, এই চুক্তিতে মাইক্রোসফট শুধু নোকিয়ার ব্যবসা ও তার ৩২ হাজার কর্মীকেই নিল না, কার্যত খুঁজে নিল নিজেদের ভবিষ্যৎ কর্ণধারকেও।
স্টিফেন ইলোপ। বাজার থেকে বিশেষজ্ঞ, সমীক্ষা থেকে জুয়ার দর মাইক্রোসফটের পরবর্তী সিইও হিসেবে এখন প্রায় সর্বত্র সবার আগে নাম উঠে আসছে কানাডায় জন্মানো এই ভদ্রলোকের। মাইক্রোসফট ছেড়ে ২০১০ সালে শীর্ষ কর্তা হিসেবে নোকিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন ইলোপ। ২০১১ সালে মূলত তাঁর উদ্যোগেই নিজেদের মোবাইলে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহারের জন্য মাইক্রোসফটের সঙ্গে চুক্তি করে নোকিয়া। এর পর ফের তাঁর নেতৃত্বেই নোকিয়া মাইক্রোসফটে মিশে যাওয়ার পর ইলোপের সিইও হওয়া নাকি স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। বিশেষত যেখানে বামার সদ্য জানিয়ে দিয়েছেন, এক বছরের মধ্যেই ওই পদ থেকে সরে যাবেন তিনি। শুরু হয়ে গিয়েছে উত্তরসূরির খোঁজও।
নোকিয়ায় এসে ইলোপ বলেছিলেন, “এই সংস্থার দশা ঠিক সেই লোকটির মতো, যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন গরম তেলের উপর। বাঁচতে চাইলে লাফ দেওয়া ছাড়া যাঁর গতি নেই।” আর এই সূত্রেই উঠে আসছে বিশ্বের বেবাক বদলে যাওয়া ছবি।
টিভি থেকে রবার বুট প্রায় সব ধরনের ব্যবসাই করেছে ১৮৬৫ সালে যাত্রা শুরু করা নোকিয়া। প্রথম মোবাইল তৈরি ১৯৮৭ সালে। ২০০৭ সাল পর্যন্তও ভারত-সহ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রায় একচেটিয়া রমরমা ছিল নোকিয়ার। মূলত তার জিএসএম (যেখানে মোবাইলে ইচ্ছেমতো সংস্থার পরিষেবা ব্যবহার করা যায়) প্রযুক্তি আর কম দামে ছোট ফোন তৈরিতে দক্ষতার দৌলতে।
কিন্তু স্মার্ট ফোন ‘বিপ্লবের পর’ ঠিক উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করল পৃথিবী। মোবাইল আর শুধু কথা বলা বা বার্তা (এসএমএস) পাঠানোর যন্ত্র রইল না। তাতে ইন্টারনেট সেঁধিয়ে যাওয়ার পর একই সঙ্গে ফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপ ও টিভির সুবিধা খুঁজতে শুরু করল মানুষ। এসে গেল টাচস্ক্রিন। মোবাইলের পর্দায় আঙুল বুলিয়েই কাজ সেরে ফেলার স্বাচ্ছন্দ্য পেল নতুন প্রজন্ম। ‘কি-বোর্ড’ওয়ালা মোবাইল ক্রমশ মিশে যেতে শুরু করল ডাইনোসরের দলে।
গত এক দশকে এই সমস্ত বদলের সঙ্গেই তাল মেলাতে পারেনি নোকিয়া। পিছিয়ে পড়েছে উদ্ভাবনের গতিতে। তাই সাধারণ মোবাইল বাজারের
১৫% (২০০৭ সালে যা ছিল ৪০%) এখনও তাদের পকেটে ঠিকই। কিন্তু স্মার্ট ফোন বাজারের মাত্র ৩% রয়েছে তাদের দখলে। সেখানে পিছন থেকে উঠে এসে বহু দূর এগিয়ে গিয়েছে অ্যাপল আর স্যামসাং। স্মার্ট ফোনের ৯৫% বাজারই এখন তাদের কব্জায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কয়েকটি বড়সড় ভুল করেছে নোকিয়া। ফিনল্যান্ড (সদর সফতর যেখানে) ছাড়াও চিন-সহ বহু দেশে কারখানা খুলতে গিয়ে অযথা বাড়িয়ে ফেলেছে খরচ। ঢিলে দিয়েছে গবেষণায়। গুগ্লের অ্যান্ড্রয়েড প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্যামসাং যেখানে অ্যাপলকেও কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে, সেখানে ঘুরে দাঁড়াতে তুলনায় অনেক কম জনপ্রিয় উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের হাত ধরেছে তারা। আর এই সবেরই মাসুল গুনে ‘ছিটকে গিয়েছে’ স্মার্ট ফোন বাজারের কক্ষপথ থেকে। লোকসান করেছে শেষ ছ’টির মধ্যে পাঁচটি ত্রৈমাসিকেই।
মাইক্রোসফটের অবস্থা অবশ্য এতটা করুণ নয়। বিক্রি কিংবা
মুনাফার অঙ্কে বিশ্বের বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা এখনও তারাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত কয়েক বছর ধরে প্রায় লাগাতার পড়েছে তাদের শেয়ার দর। যেন গায়ে তকমা লেগে গিয়েছে ‘আগের প্রজন্মের’ সংস্থার। স্টিভ জোবস অনুপ্রাণিত অ্যাপলের আই-ফোন কিংবা আই-প্যাডের সঙ্গে যুদ্ধে যে যুঝতে অক্ষম। যার সার্চ ইঞ্জিন ‘বিং’ শত চেষ্টাতেও লেজ ছুঁতে পারে না গুগলের।
আর সেই কারণেই মাইক্রোসফট বুঝেছে, এই নতুন জমানায় শুধু সফটওয়্যার সংস্থা হিসেবে মুকুট ধরে রাখা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে হাতে থাকা দরকার কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেটের মতো হার্ডওয়্যার (যন্ত্র)। নইলে তাদের সফটওয়্যার ব্যবহার হবে কীসে? একই সঙ্গে তাদের কাছে স্পষ্ট যে, এখন সময়টা নেট-অ্যাপ-সোশ্যাল মিডিয়ার।
দুনিয়া স্মার্ট ফোন আর ট্যাবলেটে মোহাবিষ্ট। তাই সংস্থা হিসেবে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে এই সবের বাজার দখল করা একান্ত জরুরি। ঠিক যে কারণে ১,২৫০ কোটি ডলার খরচ করে ধুঁকতে থাকা আর এক মোবাইল নির্মাতা মোটোরোলা-কে কিনে নিয়েছে গুগ্ল। কে কিনবে, তা নিয়ে নিয়মিত জল্পনা চলছে জৌলুস কমে আসা ব্ল্যাকবেরিকে ঘিরে। যে কারণে ট্যাবলেটের বাজারে ভাগ বসাতে সম্প্রতি ‘সার্ফেস’ এনেছিল মাইক্রোসফটও। যদিও তা তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি।
এই সব কারণেই এ বার কোমর বেঁধে নোকিয়া কিনল মাইক্রোসফট। শোনা যায়, সংস্থার এক অত্যন্ত ভাল কর্মী গুগ্লে চলে যাওয়ার কথা বলায় তাঁর দিকে চেয়ার ছুঁড়েছিলেন বামার। অনেকে বলছেন, নিজে সংস্থা ছেড়ে যাওয়ার আগে ‘চিরশত্রু’ অ্যাপল আর গুগ্লের দিকে মোক্ষম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি।
তবে তাঁর এই চেষ্টায় যে সকলে খুশি, এমনটা মোটেই নয়।
ফিনল্যান্ডের সাধারণ মানুষ যেমন মনে করছেন, প্রায় জলের দরে দেড়শো বছরের ইতিহাস কিনে ফেলল মাইক্রোসফট। মোবাইল ব্যবসা তো বটেই, ঝুলিতে পুরে ফেলল ওই বিষয়ে নোকিয়ার যাবতীয় পেটেন্টও। যে কারণে তাঁরা ইলোপের উপর খড়্গহস্ত।
সংস্থাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করাতে হাজার-হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের পরও মাইক্রোসফটের কাছে এমন ‘অসহায় আত্মসমর্পণের জন্য’ তাঁকে শাপশাপান্ত করছেন সে দেশের মানুষ।
অনেকেই মনে করছেন, শেষ হয়ে গেল আস্ত একটা যুগ। ফিনল্যান্ডের মন্ত্রী আলেকজান্ডার স্টাবের ট্যুইট, “আমাদের সেই ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া স্মৃতির প্রায় প্রতি পরতে জড়িয়ে রয়েছে নোকিয়া।” তা দেখে অনেকেই বলছেন, ভারতেরও নয় কি? আমাদের অধিকাংশেরও তো মোবাইলে হাতেখড়ি নোকিয়ার ফোনে সুইচ টিপেই।
দুই সংস্থার শেয়ারহোল্ডাররা সায় দিলে ২০১৪ সালের গোড়ার দিকেই মাইক্রোফটের শাখা হয়ে যাবে নোকিয়া। উইন্ডোজের সাফল্য স্মার্ট ফোনেও চাইবেন বিল গেটস। হবে কি? উত্তর দেবে সময়ই। |