|
|
|
|
পাহাড়ে স্বাগত মমতা, মুখরক্ষা চাইছে মোর্চাও |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি
কিশোর সাহা • কালিম্পং
|
রবিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, বিমল গুরুঙ্গের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। সোমবার বাগডোগরায় নেমে দার্জিলিঙের মানুষকে ‘আমার ভাইবোন’ বলে সম্বোধন করে তাঁদের বন্ধ থেকে সরে আসতে অনুরোধ করলেন। বাস্তবেও দেখা গেল, মোর্চার ডাকা বন্ধ উপেক্ষা করেই কালিঝোরা, চিত্রে, নয় মাইল এলাকায় বহু মানুষ মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে রাস্তায় নামলেন। এই অবস্থায় দলের বন্ধ বিরোধীরাও বেঁকে বসতে পারেন, এই আশঙ্কায় এখন সম্মানজনক মুখরক্ষার পথ খুঁজছেন মোর্চা নেতৃত্ব। যাতে বন্ধ থেকে সরে আসা যায়, আবার রাজ্যের সঙ্গে আলোচনার পথও খোলে। সেই লক্ষ্যেই আজ, মঙ্গলবার তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের সঙ্গে দেখা করবেন। |
আদর
|
মুখ্যমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে লেপচা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে
হাজির ছিল এই খুদেও।
সোমবার কালিম্পঙে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
সব মিলিয়ে পাহাড়ে বরফ গলার ইঙ্গিত মিলছে বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
এ দিন মমতা যখন পাহাড়ে পা রাখছেন, তখন রোশন গিরির নেতৃত্বে মোর্চার প্রতিনিধি দল দিল্লিতে কংগ্রেস নেতা সি পি জোশীর সঙ্গে দেখা করেন। জোশী পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত। মঙ্গলবার তাঁরা শিন্দের সঙ্গে বৈঠক করতে চলেছেন। বস্তুত, কালিম্পঙে লেপচাদের সংবর্ধনা সভায় যখন মমতা মঞ্চে উঠবেন, তখনই শিন্দের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রোশনদের। কেন্দ্রীয় প্রশাসন সূত্রে খবর, পাহাড় সমস্যা সমাধানে বরফ গলানোর কাজ অনেকটাই করেছেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। তিনি দিল্লি গিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে দেখা করেন। প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নারায়ণন দার্জিলিঙের ভৌগোলিক এবং কৌশলগত গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক অবহিত। তাই তিনি দিল্লিকেই অনুরোধ করেন গুরুঙ্গদের সঙ্গে কথা বলে আলোচনার পথ খুঁজতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে রোশনদের বৈঠকের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটা তারই ফল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে কী বলবেন রোশনরা? মোর্চা সূত্রে জানা গিয়েছে, রোশনরা শিন্দেকে জানাবেন, তাঁরা বন্ধ তুলে নিতে চান। কিন্তু মুখরক্ষার একটা পথ তো চাই। তাই তাঁরা মমতার সঙ্গে আলোচনা করতেও আগ্রহী। কেন্দ্র তা নিয়ে মধ্যস্থতা করুক। আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে পাহাড়ে মোতায়েন বিপুল পরিমাণ কেন্দ্রীয় বাহিনীর কিছুটা ফিরিয়ে নেওয়া এবং গ্রেফতার হওয়া দলীয় নেতাদের মুক্তির আর্জিও কেন্দ্রের কাছে পেশ করবেন রোশনরা। |
|
খাদা হাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভ্যর্থনা। রয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী
গৌতম দেবও।
সোমবার বাগডোগরা বিমানবন্দরে বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি। |
কেন বন্ধ থেকে সরে আসতে চাইছেন গুরুঙ্গরা? মোর্চা সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রথমত, দলেরই একটি অংশ বন্ধের বিরোধী। তার উপর মুখ্যমন্ত্রী এ দিন আন্দোলনকারীদের ‘আমার ভাইবোন’ বলায় মোর্চার অন্দরেও আলোড়ন পড়েছে। মোর্চা নেতাদের একাংশের ধারণা, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কথার মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, জনজীবন স্বাভাবিক রেখে কোনও আন্দোলন করলে তিনি আপত্তি করবেন না। তা হলে বন্ধ তুলে অন্য আন্দোলন হবে না কেন?
দ্বিতীয়ত, এমন পরিস্থিতিতে গত শনিবার মমতাকে ফোন করেছিলেন মোর্চা বিধায়ক হরকাবাহাদুর ছেত্রী। তাতেও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, বন্ধ-অবরোধের ফলে মোর্চার মধ্যেই ফাটল তৈরি হয়েছে। |
|
কালিম্পঙে মুখ্যমন্ত্রী। সোমবার রবিন রাইয়ের তোলা ছবি। |
তৃতীয়ত, বন্ধের প্রতি সমর্থন নেই পাহাড়েরই অনেক মানুষের। এ দিন দার্জিলিং, কার্শিয়াং সুনসান থাকলেও অন্যত্র মমতার সফর উপলক্ষে বহু মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি থেকে এর মধ্যেই একাধিক দল বেরিয়ে গিয়েছে। তার পরে এ দিনের বন্ধকে উপেক্ষার ঘটনায় আরও অস্বস্তিতে মোর্চা নেতৃত্ব। সেই অস্বস্তি বাড়িয়েছে এ দিন দার্জিলিঙের চকবাজারে আর একটি পোস্টার। তাতে লেখা, ‘ঘরে বসে থাকার ডাক দিয়ে নেতা, ঠিকাদার ও প্রশাসনের কর্তারা খাচ্ছেন-দাচ্ছেন আর আমজনতা উপোস করে আছেন। এটা কত দিন চলবে?’ এই নিয়ে চলতি আন্দোলনের মধ্যেই তৃতীয় বার গুরুঙ্গদের আক্রমণ করে পোস্টার পড়ল পাহাড়ে। এই ভাবে পরপর পোস্টার দেওয়াকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের অনেকে।
সর্বোপরি, বন্ধ এবং ‘ঘর ভিতরো জনতা’, দু’টিকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। তাই বন্ধ দীর্ঘদিন চালানো কঠিন। (প্রকাশ্যে কঠোর অবস্থান বজায় রাখতে আজই অবশ্য হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে মোর্চা।) |
|
লেপচাদের স্বাগতবার্তা। ছবি: রবিন রাই। |
এমনই পরিস্থিতিতে বাগডোগরায় নেমে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থাকবে। তাই দিনের পর দিন উন্নয়ন বন্ধ করে রাখা যায় না। দার্জিলিঙের ভাইবোনেদের অনুরোধ করছি, স্বাভাবিক জনজীবনে ফিরুন। পাহাড়ের আমজনতার কথা ভেবে আলোচনার রাস্তা খোলা হোক। কারণ আমি শান্তি চাই। শান্তির কথা বলতেই পাহাড়ে এসেছি। যে অনুষ্ঠানে আমি যোগ দেব, সেখানেও পাহাড়ের শান্তির জন্যই প্রার্থনা করব।”
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়-সহ শীর্ষ প্রশাসনিক কর্তারা। ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায় ও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। বিমানবন্দরে নামার পরে সেখানেই মুখ্যমন্ত্রীকে খাদা পরিয়ে দেন সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া কার্শিয়াঙের পানিঘাটার নেপালিভাষী মহিলারা। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তার পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে একটা আন্দোলনের জন্য পাহাড়ের উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। পড়াশোনা বন্ধ। এ ভাবে তো চলতে পারে না। পাহাড়ের মানুষ খুবই ভাল। সে জন্য আমি বারবার পাহাড়ে ছুটে আসি।” এ দিন তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “পাহাড়ের কারও ছেলে বিদেশে পড়বে আর কারও ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতেই পারবে না, এ কেমন কথা!” প্রসঙ্গত, চার দিন আগে দার্জিলিঙের দু’টি জায়গায় পোস্টার পড়েছিল, ‘গুরুঙ্গের ছেলেরা বিদেশে পড়বে আর পাহাড়ের ছেলেরা পড়াশোনা বন্ধ রাখবে, এটা হতে পারে না।’ |
|
সাংবাদিক বৈঠকে অশোক ভট্টাচার্য। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
বাগডোগরা থেকে মুখ্যমন্ত্রী কালিম্পঙের পথে রওনা হন। কালিম্পঙের ডম্বরচকে পৌঁছতেই মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় লেপচাদের ভিড়ে ঢাকা পড়ে যায়। সেখান থেকে মুখ্যমন্ত্রী যান সার্কিট হাউসে। সেখানে তিনি পাহাড়ের পরিস্থিতি নিয়ে সরকারি কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
মোর্চা নেতারা কেউ এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর সফর নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। গুরুঙ্গ নিজে ঘরবন্দিই ছিলেন। অন্য নেতাদেরও কাউকে রুটিনমাফিক বিবৃতি দেওয়ার জন্যেও দলীয় দফতরের বাইরে বার হতে দেখা যায়নি। তবে মোর্চার অন্দরের খবর, দিনভর গুরুঙ্গ মুখ্যমন্ত্রীর কালিম্পঙের অনুষ্ঠানে জমায়েতের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছেন। সেই সঙ্গে
দলের কেউ যাতে অশান্তিতে জড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারেও সকলকে সতর্ক করেছেন। আজ মুখ্যমন্ত্রী লেপচাদের সভায় কী বলেন, সে দিকেও তাকিয়ে রয়েছেন মোর্চা নেতারা। তাঁদের অনেকেরই মতে, মমতা যদি গুরুঙ্গ তথা মোর্চার উদ্দেশে খুব কড়া কথা না-বলেন, তা হলে সমস্যা সমাধানের পথে এগোনোর সুযোগ হতে পারে।
এর মধ্যে এ দিনও রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে পাহাড়ে সর্বদলীয় বৈঠকের দাবি তুলেছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমেই পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরতে পারে।” তাঁর কথায়, “কোনও বিভাজন নয়, সার্বিক উন্নয়ন দরকার। সেই জন্যই পাহাড়ের বর্তমান সমস্যা মেটাতে সব দলগুলিকে নিয়েই আলোচনায় বসা দরকার।” |
পুরনো খবর: গুরুঙ্গ শত্রু নন, তাই বলে ভাঙতে দেবেন না বাংলাও |
|
|
|
|
|