পাহাড়ে তাঁর সফরের সময়েই ‘ঘর ভিতরো জনতা’ স্লোগান তুলে কার্যত বন্ধের ডাক দিয়েছেন বিমল গুরুঙ্গরা। কিন্তু দার্জিলিং যাওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা আগে একান্ত সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, তিনি বিমল গুরুঙ্গের বিরোধী নন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ঐক্যবদ্ধ বাংলারও পক্ষে। এমনকী, পাহাড়ে লেপচাদের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এই লেপচা সম্প্রদায়ের মানুষরাও পাহাড়েরই অঙ্গ। আমি ডান হাতকে ভালবাসতে গিয়ে বাঁ হাতটা কেটে ফেলতে পারি না।”
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “বিমল গুরুঙ্গ সম্পর্কে আমার কোনও ব্যক্তিগত বিরোধিতার প্রশ্নই ওঠে না। বিষয়টি ব্যক্তিগত নয়। কিন্তু দার্জিলিঙে বসবাসকারী মানুষ, তাঁদের উন্নয়ন, তাঁদের ভাল কী ভাবে হবে, কীসে হবে এই সবটাই বিভিন্ন দিক থেকে দেখা প্রশাসনের দায়িত্ব।”
মমতা বলেন, “গোর্খা সত্তাকে আমরা সম্মান করি। তাই তাদের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নামকরণ ‘গোর্খাল্যান্ড’ দিয়ে করা হয়েছে। কিন্তু পৃথক রাজ্য করার যে দাবি, তা আমরা মেনে নিতে পারি না। কারণ, দেশটিকে শুধু ছোট ছোট টুকরো রাজ্যে ভাগ করলেই যুক্তরাষ্ট্রীয় স্বায়ত্তশাসন লাভ হয় না। সেটা পরীক্ষিত সত্য। সোভিয়েত ইউনিয়নে তা হয়নি, ভারতেও হয়নি। উল্টে আর একটা রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তৈরির দাবি উঠছে।” তাঁর বক্তব্য, “রাজ্য ভাগের বিষয়টি কেস-টু-কেস পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। তাই তেলঙ্গানা হয়েছে বলেই দার্জিলিঙকে আলাদা করে দিতে হবে এটা অতিসরলীকরণ।” তিনি জানিয়েছেন, রাজ্যটিকে ভাগ না করেই যাতে সব রকমের গোর্খা সত্তার স্বীকৃতি পাওয়া যায়, তাঁরা সেই ব্যবস্থা করছেন। |
আগামিকাল দু’দিনের সফরে মুখ্যমন্ত্রীর দার্জিলিঙে যাওয়ার কথা। এবং মুখ্যমন্ত্রীর যাওয়াকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই পাহাড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। মোর্চার ‘ঘর ভিতরো জনতা’-র ডাক রয়েছে। ফলে জেলা প্রশাসনেরও আশঙ্কা, মুখ্যমন্ত্রীর সফরের সময় গুরুঙ্গের দলের লোকেরা গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করতে পারে। জেলা প্রশাসনের একটি অংশ মমতাকে এই সফর বাতিল করারও পরামর্শ দিয়েছে। প্রশাসনের আর একটি অংশ ২ তারিখের সফর বদলে ১০-১৫ তারিখে সফর করারও পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের এই সব প্রস্তাবে রাজি হননি মমতা।
এখনও পর্যন্ত ঠিক রয়েছে, মমতা যাচ্ছেন। সঙ্গে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কেও নিয়ে যাচ্ছেন। মুকুলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার পিছনে মমতা আর একটি বার্তাও দিতে চান। প্রশাসনের পাশাপাশি মমতা তাঁর দলীয় অবস্থানও স্পষ্ট করে দিতে চান যে, তৃণমূল বাংলা ভাগের পক্ষে নয়। তা বোঝাতেই আরও বেশি করে মুকুলকে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
পাহাড় সমস্যায় কেন্দ্রকেও পাশে পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও এর আগে চিঠি দিয়ে তাঁর আশঙ্কা দূর করে জানিয়েছিলেন, দার্জিলিঙে যখন একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়ে গিয়েছে, তখন রাজ্য সরকারকে বাদ দিয়ে কেন্দ্র কোনও ভাবেই সরাসরি গুরুঙ্গের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে সাম্প্রতিক সমস্যা মেটাতে সচেষ্ট হবে না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সূত্র জানাচ্ছে, গুরুঙ্গ নিজে দিল্লি এসে সরাসরি মমতার বিরুদ্ধে নালিশ জানানো কিংবা তাঁদের প্রতিনিধিদলকে পাঠিয়ে কেন্দ্রের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার সব রকম চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কেন্দ্র তা করতে সম্মত হয়নি।
দার্জিলিঙের পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে বিমল গুরুঙ্গের সঙ্গে রাজ্য সরকারের একটি স্নায়ুর যুদ্ধ চলছে। কেন্দ্র এবং রাজ্যের কাছ থেকে গুরুঙ্গ তাঁর গোর্খা পার্বত্য পরিষদের জন্য আর্থিক ভাবে অনেকটাই নির্ভরশীল। এই অভ্যন্তরীণ সংঘাত-কলহে তাঁর আর্থিক সাহায্যের সরবরাহ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে গুরুঙ্গের দল অভিযোগ করছে। তার মধ্যে গুরুঙ্গের হুমকিতে মমতার দিক থেকে কঠোর মনোভাব দেখানোয় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গিয়েছে। |
এই বিষয়টি সম্পর্কে মমতা বলেন, “দার্জিলিঙের মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক উন্নয়ন এ ব্যাপারে আমরা আমাদের অগ্রাধিকার কোনও ভাবেই বদলাচ্ছি না। উন্নয়নের টাকা নিয়ে যাতে নয়ছয় না হয়, শুধু দার্জিলিং বলে নয়, রাজ্যের সব জেলাতেই সেটা দেখাটা আমার কর্তব্য। দার্জিলিং একটি জেলা হিসেবে তার থেকে আলাদা হতে পারে না।” তাঁর বক্তব্য, দার্জিলিঙের মানুষের প্রতি দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনে যে অবিচার হয়েছে, তা থেকে দার্জিলিঙের মানুষকে বের করে আনাটাও তাঁর বড় লক্ষ্য। মমতার প্রশ্ন, “পর্যটন ক্ষতিগ্রস্ত হলে লোকসান কার? দার্জিলিঙে জলের সঙ্কট কিংবা রাস্তা মেরামত না হলে লোকসান কার?” এর জবাব দিতে গিয়েই তিনি বলেছেন, “তাই মানুষের কথা ভেবে আমি ওঁদের কাছে আবেদন করছি, অবিলম্বে জিটিএ প্রধানের পদে নির্বাচন করা হোক। মনোনীত সদস্যদের কাউকে এই পদে না এনে নির্বাচিতদের মধ্যে থেকে কাউকে এর জন্য বাছা হোক। যাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি সরাসরি মানুষের জন্য কাজ করতে পারেন।” গুরুঙ্গদের নিয়ে তাঁর খেদ, “কিন্তু এই প্রস্তাবে ওঁরা রাজি হচ্ছেন না। কেন রাজি হচ্ছেন না, সেটি ওঁরাই ভাল বলতে পারবেন।”
আপনি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বলেছিলেন, পাহাড় হাসছে। এখন তো আর তা বলা যাচ্ছে না?
জবাবে মমতা বলেন, “খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছি। সেই চুক্তিতেই কিন্তু লেপচা বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কমিটির কথা বলা হয়েছিল। সেই কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্ত সকলে মেনে নেবে, সেটিও চুক্তির অঙ্গ।” তিনি এখনও মনে করেন, তাঁরা ক্ষমতায় আসার পর দার্জিলিঙের পরিস্থিতি আমূল বদলেছে। “দার্জিলিং ঘিরে যে প্রবল হতাশার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা কাটাতে আমি আরও বেশি করে বলেছিলাম, দার্জিলিং হাসছে। আমি এখনও একই কথা বলছি,” বলেছেন তিনি। কারণ? “যাতে পাহাড় এবং সমতলের মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে দার্জিলিঙের প্রশ্নে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়।”
দার্জিলিঙের ভৌগোলিক এবং তার ফলে কৌশলগত তাৎপর্য রয়েছে এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে মমতার বক্তব্য, “নানা ধরনের শক্তি ভারতের স্থায়িত্বকে নড়বড়ে করে দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করে চলেছে। তাই আমি কংগ্রেস এবং সিপিএমকে বারণ করব, তাঁরা যেন অন্তত পাহাড় নিয়ে রাজনীতি না করেন। তাঁদের এখন উচিত রাজনীতি থেকে সরে দার্জিলিঙের মানুষের হাসি অম্লান রাখা।”
|
নরম গরম |
• গুরুঙ্গ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত বিরোধিতার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কীসে পাহাড়ের মানুষের ভাল হবে, তা দেখা প্রশাসনের দায়িত্ব।
• লেপচারাও পাহাড়ের অঙ্গ। ডান হাতকে ভালবাসি বলে আমি বাঁ হাতটা কেটে ফেলতে পারি না।
• গোর্খা সত্তাকে সম্মান করি। তাই স্বশাসিত সংস্থার নামকরণে ‘গোর্খাল্যান্ড’ আছে। কিন্তু পৃথক রাজ্যের দাবি মেনে নিতে পারি না।
• রাজ্য ভাগের বিষয়টি কেস-টু-কেস দেখা দরকার। তেলঙ্গানা হয়েছে বলেই দার্জিলিংকে আলাদা করে দিতে হবে এটা অতি সরলীকরণ। |
|