|
ভাঙা রাস্তা হকারের দখলে,
যানজটে নাভিশ্বাস যাত্রীদের
দিলীপ নস্কর • ডায়মন্ড হারবার |
জেলা শহরগুলির ব্যস্ততম পথ। প্রায় সর্বত্র বেদখল, বেহাল। নিত্যযাত্রীর
নিত্য-দুর্ভোগ সরেজমিনে দেখছে আনন্দবাজার পত্রিকা। আজ শেষ কিস্তি। |
|
মোহনা যে কাছেই, তা বোধহয় রাস্তা দেখলেই মালুম হয়। কিন্তু পুরভোট যে কাছে, তা মালুম হয় না।
এক পা অন্তর গর্ত। তাতে ঘোলা জল ছলছল করছে। তিন ভাগ জলের পাশে যতটুকু স্থল, বেশিরভাগটাই শাকসব্জি-লরি-রিকশার দখলে।
সংক্ষেপে এই হল ডায়মন্ড হারবার স্টেশন রোড। সে রাস্তা মাড়িয়ে লোকে যে শুধু হন্তদন্ত হয়ে কাজে যায় তা নয়, বেড়াতেও আসে। কিন্তু স্টেশনের বাইরে পা দিলেই বিরক্তি আসতে বাধ্য।
কাকদ্বীপ থেকে ডায়মন্ড হারবার হয়ে যে ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক কলকাতার দিকে চলে গিয়েছে, তা থেকে গুরুদাসনগর স্টেশনের দিকে সোজা আড়াইশো-তিনশো মিটার রাস্তা। চওড়ায় ফুট তিরিশেক। ওরই মধ্যে দু’পাশে ফল, শাকসব্জি, আরও নানা দোকান। তার পরেও যত্রতত্র ডালা পেতে বসে বিক্রেতারা। বাকি যে এক ফালি রাস্তা পড়ে রইল, সেটুকুতেও লরি, ম্যাটাডর, সাইকেল, ভ্যানরিকশা দাঁড় করানো। স্টেশনে ট্রেন ঢুকলেই বেধে যায় যানজট। যাত্রীদের স্টেশন মোড়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা থাকলেও সেখান দিয়ে সবাই এক সঙ্গে যাতায়াত করতে পারে না। ফলে স্টেশন রোড দিয়েই প্রধান সড়কে যেতে হয়। কিন্তু সে রাস্তায় এখন পিচ-টিচ উঠে একাকার। খানাখন্দে টইটুম্বুর বর্ষার জল।
স্টেশন মোড় কার্যত শহরের প্রাণকেন্দ্র। সেখানে রাস্তার দু’ধারে ভ্যানরিকশা, অটোর দাপাদাপি। মোড় থেকে ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতাল যাওয়ার ফুটপাথও ফল ব্যবসায়ীদের দখলে। সেখান দিয়ে হাঁটতে যাওয়া মানে নরকযন্ত্রণা। |
স্টেশন রোড এবং ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক যানজটমুক্ত করতে এর আগে বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেছে পুলিশ-প্রশাসন এবং পুরসভা। কিন্তু স্থায়ী সমাধান হয়নি। শহরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, যথাযথ পরিকল্পনা এবং সদিচ্ছার অভাবেই প্রতিনিয়ত যানজট হচ্ছে। রাস্তা-ফুটপাথ হকারদের দখলে চলে যাওয়ায় চলাফেরা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে সব শুনছে কে? এখন তো বরং ভোটই বড় অজুহাত।
প্রথমে শোনা যাক প্রশাসন কী বলছে। ডায়মন্ড হারবারের ভারপ্রাপ্ত মহকুমাশাসক মৌমিতা সাহা বলেন, “ওই রাস্তা সংস্কারের জন্য রেল দফতরকে বলা হয়েছিল। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, যেহেতু সামনে পুরভোট, তাই এখন সংস্কারের কাজ করা যাচ্ছে না। ভোট মিটলে সারানো হবে।” রেলপুলিশ সূত্রে আবার বলা হয়েছে, বিষয়টি তাদের জানা নেই। রেলের তরফে যদি দখলদার তুলতে বলা হয়, তবেই তারা ব্যবস্থা নেবে। পুলিশের দাবি, রাস্তা হকারমুক্ত রাখতে তারা নিয়ম করে ‘অভিযান’ চালায়। কিন্তু সে অভিযান কেমন কাজের, তা এলাকার লোক মাত্রেই জানেন। লাঠি হাতে খাকি উর্দি পিছন ফিরলেই ফের যে কে সেই।
রাজনৈতিক নেতাদের তো আবার ভোট বড় বালাই। তাঁরা তাই এখন হকার উচ্ছেদের মতো ‘কড়া সিদ্ধান্ত’ যেন তেন প্রকারেণ এড়িয়ে চলছেন। মন্তব্যের ব্যাপারেও সকলেই অতি সাবধানী। মোদ্দা কথা একটাই ‘ওরা করে খাচ্ছে। পেটে লাথি মারি কী করে? বিকল্প ব্যবস্থা না করে তোলা যাবে না!’ কিন্তু তেমন কোনও ‘ব্যবস্থা’ আদৌ হয়ে ওঠেনি।
গত দশ বছর ডায়মন্ড হারবার পুরসভা চালিয়ে ফের শক্তিপরীক্ষা দিতে যাচ্ছে শাসকদল তৃণমূল। পুরসভা থেকে যানজট হটাতে এক সময়ে তারা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী দিয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেছিল। সেই ব্যবস্থা এখনও বলবৎ আছে। কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে তা আদৌ যথেষ্ট নয়। বিদায়ী পুরপ্রধান, তৃণমূল নেতা পান্নালাল হালদারও মেনে নেন, ‘যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে পুরসভা থেকে ২০ জন স্বেচ্ছাসেবী রাখা হয়েছে। তবে সারা দিনে হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করায় কিছু সমস্যা হচ্ছে।” তাঁর দাবি, “হকার উচ্ছেদের ব্যাপারেও আমরা উদ্যোগী হয়েছি। তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে হকারস কর্নার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।”
গত এক দশকে যখন সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি, এই মুহূর্তে হওয়ার প্রশ্নই নেই। তবে তার জন্য বিরোধীরা যে গলা ফাটাচ্ছেন বা শাসকদের কাঠগড়ায় তুলে প্রচারে গলা ফাটাচ্ছেন, তেমনও তো নয়। বাস্তব বরং উল্টোটাই। সিপিএমের ডায়মন্ড হারবার জোনাল সম্পাদক সমর নাইয়ার বক্তব্য, “এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। রাতারাতি হকার উচ্ছেদ করতে বলতে পারি না। এর সঙ্গে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে।” যানজট তবে রয়েই যাবে? সমরবাবুর মতে, “যত্রতত্র বাসল দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে-নামায়। তার ফলেই যানজট হয়। বাসস্ট্যান্ডও পরিকল্পনামাফিক হয়নি। যানজট রুখতে পুরসভার আরও উদ্যোগী হওয়া উচিত ছিল।”
এই চাপানউতোর আর ভোটের অঙ্কের দশচক্রে সাধারণ মানুষ তবে ভুগতেই থাকবে? কোনও নেতার কাছেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।
|