‘অর্জুন’ সম্পর্কে ‘দ্রোণাচার্য’-কে জিজ্ঞাসা করায় তিনি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ‘হো-ও-হো-ও’ বলে উড়িয়েই দিলেন সব কিছু!
আর গুরু সম্পর্কে শিষ্যের মনোভাব কী জানতে চাওয়ায় উত্তর এল, “আমরা দু’জনেই পেশাদার। যে যার নিজের মতো এখন কাজ করি।”
এগারো বছর আগে উইম কোভারম্যান্সের ছাত্র ছিলেন বাংলাদেশের বর্তমান কোচ লোভভিক ডি ক্রুয়েফ। নেদারল্যান্ডসে তাঁর ফিফার ‘প্রো’ লাইসেন্স কোর্সের পরীক্ষক ছিলেন বর্তমান ভারতীয় দলের কোচ। এবং গোলাকার পৃথিবীর অমোঘ নিয়মে ফুটবলের ম্যাপে দু’জনেই এখন একই গোলার্ধে হাজির। দক্ষিণ এশিয়ার দু’দেশের কোচ হয়ে। প্রথমবার যুদ্ধক্ষেত্রে!
সাফ কাপে তাই আজ গুরু আর শিষ্যের লড়াই!
লড়াই টোটাল ফুটবলের ধাত্রীগৃহ থেকে আসা দুই ডাচের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক আর ট্যাকটিক্সের।
কিন্তু এর বাইরেও আরও একটা মাইলস্টোন পেরিয়ে যাওয়ার স্বপ্নের গল্প আছে। একটা গোল করতে পারলেই আই এম বিজয়নকে টপকে যাবেন সুনীল ছেত্রী। তিনটি গোল করলে টপকে যাবেন ভাইচুং ভুটিয়াকেও। দেশের হয়ে চল্লিশ গোল করে ফেলা ভারত অধিনায়ককে সোমবার দুপুরে টিম হোটেলে দেখলাম বেশ টেনশনে। রবিবার যা সুযোগ পেয়েছিলেন তাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই জাতীয় দলের হয়ে গোল করার আগের সব রেকর্ড দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারতেন তিনি। উঠতে পারতেন ভারতীয় ফুটবলের কাঞ্চনজঙ্ঘায়। পারেননি বলে আফশোস আছে? “ঠিক আছে। গতকাল পারিনি। কালকে চেষ্টা করতে হবে। কোশিস করেঙ্গে। তবে টিম তো জিতেছে। রেকর্ড আমার কাছে একটা সংখ্যা মাত্র,” চাপ তাড়াতে বলে দেন পর্তুগালে খেলে আসা স্ট্রাইকার। তারপর ঢুকে যান ডাইনিং হলে। |
গ্রুপ লিগের অঙ্কে কালকের ম্যাচ শেখ হাসিনার দেশের কাছে ‘ডু অর ডাই’। জিতলে এ বারের সাফে টিকে থাকবে ‘আমার সোনার বাংলা’, না হলে বিদায়। আর ভারতের কাছে এই ম্যাচ শেষ চারে ওঠার সিঁড়ি নিশ্চিত করার। জিতলেই যে সেমিফাইনালে চলে যাবেন মেহতাব-নবিরা।
আজ মঙ্গলবার ম্যাচের আগে যাঁর লেখা জাতীয় সঙ্গীতে নিজেদের উদ্বুদ্ধ করবেন দু’দলের ফুটবলাররা তিনি— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু ম্যাচের আগের দিন কোভারম্যান্স বা ক্রুয়েফ দু’জনকে দেখেই মনে হল, কেউই ‘শান্তিনিকেতনের ছাত্র’ হয়ে মাঠে নামতে চান না। হোটেলের লবিতে হাত মেলালেও একে অন্যকে উড়িয়ে দিতে তূণে থাকা সব শক্তিশেল প্রয়োগ করতে চান। এবং লিখতে দ্বিধা নেই, এই লড়াইয়ে সব দিক থেকেই অ্যাডভান্টেজ উইম কোভারম্যান্সের ভারত। তা এক ম্যাচ জিতে থাকার অঙ্ক হোক বা শক্তিতে।
পাক-জ্বর যে কী ভাবে গ্রাস করেছিল টিম ইন্ডিয়াকে তা আরও মালুম হল সোমবার সকালে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় পনেরো মিনিট পর পুলিশ মাঠে ঢুকল নবি-অর্ণব-ফ্রান্সিসদের টিম বাস। নাটকীয় ভাবে তুলে নেওয়া হল মিডিয়ার জন্য জারি সব নিষেধাজ্ঞা। হল না, ক্লোজড ডোর অনুশীলনও। পাহাড় ঘেরা কাঠমাণ্ডুর টানা ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেও যেন রোদ উঠেছে কোভারম্যান্সের টিমেপাকবধের আনন্দে! “পাকিস্তানের ম্যাচটা ছিল আমাদের কাছে সবথেকে কঠিন হার্ডল। সেটা পেরিয়ে আসায় চাপ তো কমেছেই।” বলছিলেন নির্মল ছেত্রী। সরকারি প্রেস কনফারেন্সে আজ দিন ছিল তাঁর। তারপর যা বললেন তা বাঁধা গতের । যা প্রতিদিন শুনছি সবার মুখে। “সব ম্যাচই ফাইনাল। বাংলাদেশকেও আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি। চাম্পিয়ন হতে গেলে সব ম্যাচ জিততে হবে।”
প্রথম ম্যাচে নেপালের কাছে বিশ্রী হেরে তীব্র চাপে আছেন বাংলাদেশের ডাচ কোচ। একে একে পুরো টিম ম্যানেজমেন্ট ভর্তি করে ফেলছেন স্বদেশি লোকজন দিয়ে। আর এতে ভাল কিছু হতে পারে এই আশায় কাঠমাণ্ডুতে উপচে পড়েছে পদ্মাপারের মিডিয়া। জনা ষাটেক বাংলাদেশি সাংবাদিক ক্রুয়েফকে ছিঁড়ে খাচ্ছেন প্রতি দিন। ডাচ কোচ তাই মরিয়া। “নেপালের বিরুদ্ধে আমাদের মনোভাব যতটা আক্রমণাত্মক ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ঝাঁপাতে হবে ভারতের বিরুদ্ধে। মনে রাখতে হবে, ম্যাচ না জিতলেই বিদায়।” সোয়েল রানা-জামালদের টিম মিটিংয়ে বলে দিয়েছেন তিনি।
আর ধারে-ভারে এগিয়ে থেকেও কোভারম্যান্স ভয় পাচ্ছেন, বিপক্ষের এই মরিয়া মনোভাবকেই। “আমরা এখানে ট্রফি জিততে এসেছি। জানি কাল বাংলাদেশের বাঁচার লড়াই। ওরা মরিয়া হবে। সে ভাবেই আমরা তৈরি হচ্ছি।” অনুশীলন শুরুর আগে বলে দিলেন ভারতীয় কোচ। এ দিন অবশ্য হালকা অনুশীলন হল সুব্রত-অর্ণবদের। বড় জোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট। প্রথম একাদশে যাঁরা ছিলেন তাঁদের শুধু-ই স্ট্রেচিং। বাকিদের সামান্য বল নিয়ে চোর-পুলিশ খেলা। যাতে সামিল হলেন কোচও। সন্ধ্যায় দেখানো হল বাংলাদেশের খেলা পাঁচটি ম্যাচের নির্বাচিত অংশ। তাতে শেষ নেপাল ম্যাচটাও ছিল। “একদিন অন্তর ম্যাচ খেলতে হচ্ছে আমাদের। বাংলাদেশ কিন্তু দু’দিন বিশ্রাম পেয়ে গেল। আমি চেয়েছিলাম একদিন আগে ওদের খেলার দিনই আমাদের ম্যাচ দেওয়া হোক,” প্রকাশ্যেই ক্ষোভ জানালেন নবিদের কোচ।
বাংলাদেশ টিমটার ইঞ্জিন মামুনুল ইসলাম চোটের জন্য এই ম্যাচেও অনিশ্চিত। ৪-২-৩-১-এ স্ট্রাইকারের পিছন থেকে তিনিই পুরো টিমে পিভটের কাজ করেন। পাস বাড়ান। তিনি না থাকায় সমস্যায় বাংলাদেশ কোচ। নবি-সুব্রতর কার্ড নিয়ে চিন্তায় থাকলেও ভারতের কোনও চোট সমস্যা নেই। তবে টিমে কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন ডাচ কোচ। “পরপর ম্যাচ। সবাইকে বিশ্রাম দিয়ে দিয়ে খেলাতে হবে,” বলছিলেন কোভারম্যান্স। পাক ম্যাচের ‘ফ্লপ বয়’ মোহনরাজের সঙ্গে প্র্যাক্টিসের আগে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে দেখা গেল কোচকে। টিম সূত্রের খবর, নবিই আজ লেফট ব্যাকে শুরু থেকেই নামছেন। আর সুনীলের পিছনে ‘ফলস নাইন’ হবেন জুয়েল রাজা। পরিস্থিতি যা তাতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আজ বহু দিন পর ভারতীয় দলে খেলবেন অর্ধেক বঙ্গসন্তান।
২০০২-এ বাংলাদেশের কোচকে পাস করিয়েছিলেন কোভারম্যান্স। এ দিন সেই ক্রুয়েফকেই ‘ফেল’ করাতে হবে তাঁকে!
কেমন লাগছে ব্যাপারটা? ইউরো কাপ জয়ী প্রাক্তন ডিফেন্ডারের মুখ থেকে বেরোলো শুধুহো-ও-হো-ও।
আর তাঁর ছাত্র লোভভিক ডি ক্রুয়েফ? গুরুকে তাঁর হুঙ্কার, “ভারতের দুর্বলতা বুঝে গিয়েছি। মাঠে দেখিয়ে দেব।”
|
মুখোমুখি ভারত-বাংলাদেশ |
মোট ম্যাচ ২৯
ভারতের জয় ১৭
বাংলাদেশের জয় ৫ |
অমীমাংসিত ৭
ভারত গোল করেছে ৪০
গোল খেয়েছে ১৯ |
|
শেষ পাঁচ লড়াই |
১৭ ডিসেম্বর ’০৫, সাফ কাপ, ভারত-২: বাংলাদেশ-০
১৯ অগস্ট, ’০৬, সাফ গেমস, ভারত-২: বাংলাদেশ-১
২০ অগস্ট ’০৭, নেহরু কাপ, ভারত-১: বাংলাদেশ-০
১১ ডিসেম্বর, ’০৯, সাফ কাপ, ভারত-১: বাংলাদেশ-০
৫ ফেব্রুয়ারি,’১০, সাফ গেমস, ভারত-০: বাংলাদেশ-১ |
|
|
সাফে রেকর্ড করলেন আশফাক
সংবাদসংস্থা • কাঠমান্ডু |
সাফ কাপে অনন্য নজির গড়লেন মলদ্বীপের অধিনায়ক আলি আশফাক। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে করলেন হ্যাটট্রিক। তাও আবার ডাবল। সোমবার সাফ কাপে আশফাকের ছয় গোলের সৌজন্যে গ্রুপ বি-র লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কাকে ১০-০ হারাল মলদ্বীপ। ডাবল হ্যাটট্রিক করে সাফ কাপের কোনও ম্যাচে রেকর্ড নম্বর গোল করার ইতিহাস গড়লেন আশফাক। পাঁচ মিনিটের মাথায় আশাদুল্লা গোল করে ১-০ এগিয়ে দেন মলদ্বীপকে। শ্রীলঙ্কার দুর্বল রক্ষণের সুযোগ নিয়ে ২১ মিনিটে আশফাক ২-০ করেন। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগে নিজের দ্বিতীয় গোলটি করেন মলদ্বীপের নিউ র্যাডিয়ান্ট ক্লাবের স্ট্রাইকার। দ্বিতীয়ার্ধে আরও চারটে গোল করেন আশফাক। অধিনায়ক ছাড়াও গোলের তালিকায় ছিলেন ইসমাইল, আল ফাসিল ও উমার। মলদ্বীপের হয়ে আশফাকের অভিষেক হয় ২০০৩ সালে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ৪০ ম্যাচে ৩৮ গোল করেছেন আশফাক। পূর্বেও নিউ র্যাডিয়ান্ট ক্লাবের হয়ে একটি ম্যাচে পাঁচটা গোল করেছিলেন আশফাক। এ দিন আর এক গ্রুপ বি-র ম্যাচে ভুটানকে ৩-০ হারাল আফগানিস্তান। গোল করেন হারুন আমিরি, মুস্তাফা এবং হাসমাতুল্লাহ।
|