সকাল সাড়ে সাতটা, ১ সেপ্টেম্বর, রবিবার...
রাজারহাট বাইপাস ধরে তীব্র গতিতে ছুটছে সিএবি-র গাড়ি। বাকি আর মিনিট পঁয়তাল্লিশ, তার পরই শহরে ঢুকে পড়বেন রবিবাসরীয় কলকাতার সবচেয়ে হাইপ্রোফাইল পর্যটক।
নাম? নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন।
কেষ্টপুরের কাছাকাছি এসে এক সিএবি কর্তা ফোনে ধরতে গেলেন শ্রীনি-র ব্যক্তিগত সচিবকে। কপাল খারাপ, ফোন বন্ধ! গাড়িও দাঁড়িয়ে পড়ল মুহূর্তে। জনা দশেক সিএবি কর্তা তখন মোটামুটি চরম বিভ্রান্তিতে। শ্রীনি শেষ পর্যন্ত আসছেন তো? নাকি ‘আজ আসছি, কাল আসছি’ বলে শেষ মুহূর্তে আরও একটা ঝটকা দিতে চলেছেন? টেনশন যদিও বেশিক্ষণ সহ্য করতে হয়নি। জানা গেল, শ্রীনি আসছেন। তবে সাড়ে আটটা নয়, সওয়া নটায়। কেন?
কলকাতা-সফরের আগে মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিলেন বলে!
সকাল সাড়ে ন’টা, রবিবার, এয়ারপোর্ট...
মুখচোখে একরাশ বিরক্তি। গাড়ির দরজা খুলে ঢুকে এক সিএবি কর্তার সামনেই হুঙ্কার, “আরে, মিডিয়ার কি কাণ্ডজ্ঞান সব লোপ পেয়েছে? এয়ারপোর্টের মুখে ওরা কী জিজ্ঞেস করছিল? কীসের রিপোর্ট জমা পড়বে?” মুখের কথা শেষ হল না, সোজা ফোন তামিলনাড়ু ক্রিকেট সংস্থার সচিব কাশী বিশ্বনাথকে। এক প্রশ্ন কীসের রিপোর্ট? এবং কোনও সদুত্তর নেই। কোনও মতে শ্রীনিকে বোঝানো হল, মিডিয়া ভুল করেছে। ওয়ার্কিং কমিটির নোটিশকে হয়তো রিপোর্ট বলছে। শুনে বুঝি একটু শান্ত হলেন। তার পরই তিনটে প্রশ্ন। পরপর।
প্রশ্ন ১: ওয়ার্কিং কমিটির আগে একটা মিটিং করব। মিস্টার ডালমিয়া হোটেলে কখন ঢুকছেন?
প্রশ্ন ২: বোর্ডের বার্ষিক সভাটা ভাবছি চেন্নাইয়ে করব। খারাপ হবে?
প্রশ্ন ৩: শনিবার রাত থেকে তো সদস্যরা ঢুকছে। কেউ কিছু বলছে মিটিং নিয়ে? |
তিনি যে ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের বর্তমানে সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্র, সবচেয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ক্রিকেট-প্রশাসক বুঝতে বুদ্ধি খরচের দরকার নেই। কিন্তু রবিবাসরীয় কলকাতা বৈঠককে ঘিরে যে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনকে পাওয়া গেল সারা দিন, তাঁর কাহিনি একটু আশ্চর্য শোনাতে পারে। কখনও তিনি থেকে গেলেন দুঁদে প্রশাসক হিসেবে। যখন বৈঠকে শ্রীনি-বিরোধী গোষ্ঠী থেকে টুঁ শব্দটুকুও হল না! কখনও তিনি প্রবল ভাবে ধর্মীয় মনোভাবসম্পণ্ণ। যখন ঘনিষ্ঠদের বলে ফেললেন, “আর একটা দিন থাকলে দক্ষিণেশ্বর ঘুরে আসতাম।” কখনও স্রেফ স্ট্র্যাটেজিস্ট। যখন দক্ষিণ আফ্রিকা বোর্ডের সিইও হারুণ লর্গ্যাটকে চাপে রাখতে বৈঠকে অন্তর্বর্তিকালীন বোর্ড প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়াকে বলে দেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আনার ব্যবস্থা তিনিই করছেন। কথাবার্তা বলে নিচ্ছেন। ওটা নিয়ে ভাবতে হবে না। আবার কখনও তিনি সেই চেনা শ্রীনি, জাতীয় মিডিয়াকে দেখলেই যিনি তীব্র জ্বলুনিতে ভোগেন, বলে দিতে পারেন, “আমিই প্রেসিডেন্ট!”
উপরের মুখবন্ধ থেকে তাই কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। পুরো কাহিনির মেজাজ মোটেও নয়।
রাতে বোর্ডের এক কর্তা বলছিলেন, “শ্রীনি আজ যা যা ঠিক করে এসেছিল, সবই কিন্তু করে গেল।” কথাটা বোধহয় এক দিক থেকে ঠিক। আইনি জটিলতা এড়াতে সঙ্গে করে আইনজীবী আনা থেকে শুরু করে, বোর্ড বৈঠকের আগে আরও একটা হাইপ্রোফাইল বৈঠকে (যেখানে অরুণ জেটলির সঙ্গেও কথাবার্তা হল ভিডিও কনফারেন্সে) ডালমিয়াকে বলে দেওয়া ‘আইনি জটিলতা বর্তমানে আছে। কিন্তু নির্বাচনের দিনটাও ঠিক করা ফেলা প্রয়োজন। নইলে ভারতীয় ক্রিকেট সমস্যায় পড়বে। তাই আমি নয়, আজ আপনিই চেয়ার করবেন। সচিব সঞ্জয় পটেল আপনার নাম প্রস্তাব করবেন। সেকেন্ড করবেন কোষাধ্যক্ষ রবি সবন্ত।’
বৈঠকেও ঠিক তাই হল। শোনা গেল, ডালমিয়া শুরুতেই বলে দেন যে, কিছু সাংবিধানিক কাজকর্মের জন্য শ্রীনিবাসন বৈঠকে আছেন। যেগুলো বার্ষিক সভার আগে মিটিয়ে ফেলা দরকার। বার্ষিক অ্যাকাউন্টসে সইসাবুদের সময় শ্রীনি মুখ্য হয়ে দাঁড়ান। পাশাপাশি ক্রিকেটের শুদ্ধকরণ করতে ডালমিয়ার পাঁচ দফা প্রস্তাব অনুমোদন পেয়ে যায়। বোর্ডের পূর্বাঞ্চলীয় অ্যাকাডেমিও পেয়ে যায় সিএবি। এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা হয়। আর ঠিক হয় নির্বাচনের দিনক্ষণ। দিল্লি শ্রীনির পছন্দ ছিল না। মুম্বই তো আরও-ই নয়। চেন্নাই বা কলকাতা ছিল পছন্দের কেন্দ্র হিসেবে। কিন্তু শেষে নির্বাচন চেন্নাইয়েই চলে যায়। |
বজ্র আঁটুনির ৫ দাওয়াই |
• দুর্নীতিদমন ও নিরাপত্তা ইউনিটের অফিসিয়াল নিয়োগ। প্রত্যেক টিমের জন্য দক্ষ নিরাপত্তা কর্মী।
• ডাগআউট আর ম্যাচ অফিসিয়ালদের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ। কড়া আচরণবিধি চালু।
• টুর্নামেন্ট চলাকালীন প্লেয়ার/ সাপোর্ট স্টাফ/ম্যাচ অফিসিয়ালরা কোনও উপহার নিতে পারবেন না। টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার ১৫ দিন আগে তাঁদের গ্রহণ করা উপহারের মোট মূল্য আর কার কাছ থেকে উপহার নিয়েছেন সেটা প্রকাশ করতে হবে।
• প্লেয়ার আর সাপোর্ট স্টাফের চালু মোবাইল নম্বর জানাতে হবে। টিম ম্যানেজারের অনুমতি ছাড়া হোটেলের নম্বরে আসা কোনও ফোন ধরা যাবে না।
• প্রয়োজন পড়লে দুর্নীতিদমন ও নিরাপত্তা ইউনিটের অফিসিয়ালরা স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কাছে সাহায্য চাইবেন। |
(চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টিতে গড়াপেটা রুখতে পাঁচ দফা প্রস্তাব ডালমিয়ার) |
|
দুপুর-দুপুর কেউ কেউ রসিকতা করছিলেন, একই বৈঠকে দু’জন প্রেসিডেন্টকে বোর্ডের পঁচাশি বছরের ইতিহাসে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি, পাশাপাশি দু’টো চেয়ারে দু’জনকে বসে থাকতে! কেউ আবার সরস ভাবে ব্যাখ্যা করছিলেন, কী ভাবে বোর্ডের কোনও কোনও সদস্য এ দিন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন শ্রীনি-র হাঁকডাকে। পুরনো আমলে যা হত, তা নাকি আজও দেখা গিয়েছে। কী রকম? একটা উদাহরণ শোনা গেল। লাঞ্চের সময় রাজীব শুক্লকে খোঁজাখুঁজি করছিলেন শ্রীনি। একটু পর রাজীব হাজির হলে শ্রীনি নাকি জানতে চান, কোথায় ছিলেন? উত্তরে রাজীব বলেন যে কলকাতার লুচি তাঁর বড়ই প্রিয়। সেটা খেতে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রায় কাছাকাছি সময়ে তাঁকে আবার পাওয়া গিয়েছে হোটেলের লবিতে! মিডিয়া পরিবেষ্টিত হয়ে!
এবং সব কিছু দেখে অনেকেরই মনে হচ্ছে বোর্ডে শ্রীনি-র সেই পুরনো প্রভাব ফিরে আসছে। যেখানে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কিছুর ‘রিমোট কন্ট্রোল’ তাঁর হাতে থাকত। এ দিনও কি হল না? প্রেস কনফারেন্স তুলে ফিরল প্রেস রিলিজ। যেটা ডালমিয়া-শুক্লকে নিয়ে বসে শ্রীনি তৈরি করলেন। যা তাঁর ঘনিষ্ঠদের কারও কারও কথায়, শ্রীনির পরিচিত স্টাইল!
আর মুখোমুখি মিডিয়ার ঢেউ সামলানো?
বরাদ্দ বড়জোড় আধ মিনিট। তা-ও নিরাপত্তারক্ষীরা আশেপাশে ছিল না বলে। এবং মাত্র দু’টো প্রশ্নের উত্তর।
চাপ কাটল আপনার?
“কীসের চাপ? কোনও চাপে কখনওই ছিলাম না।”
২৯ সেপ্টেম্বর কে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসছেন? আপনি না ডালমিয়া?
“আমি। আমি কখনওই কোনও অপরাধ করিনি। কোনও অভিযোগও আমার বিরুদ্ধে নেই। মিডিয়ার একটা অংশ আমাকে টেনে নামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না!”
বলে সটান গাড়ি ধরে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হয়ে গেলেন শ্রীনি। উপস্থিত মিডিয়াকে বিস্ময়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে। |