মা নেই।
মা-হারানোর শোক ভুলতে পাঁকাল জলে একটু যে মুখ ডুবিয়ে থাকবে, বছর ছয়েকের জলহস্তী শাবকের সে সুযোগটুকুও নেই!
লোহার গরাদের ঘেরাটোপে জলের জন্য আকুল হয়ে হাঁসফাঁস করা সেই জলহস্তী ছানার জন্য বরাদ্দ সারা দিনে বার-ছয়েক বড় হোস পাইপে জলের স্প্রে। গা-টা একটু ভিজিয়ে রাখা, এই যা। আপাতত তা নিয়েই তার বেঁচে থাকার লড়াই।
মঙ্গলবার রাতে, আলিপুর চিড়িয়াখানায় বছর আঠাশের জলহস্তিনী পাপ্পি মারা যাওয়ার পরে তার ছানার জন্য বরাদ্দ এখন ডাঙা, জল নয়। জলহস্তী-এনক্লোজারের ঢালাও চৌবাচ্চায় এখন সাফ-সুতরো করার কাজ চলেছে। চিড়িয়াখানা সূত্র বলছে, কাজটা অন্তত দিন পাঁচেকের। আপাতত তাই জলে নামা বারণ তার।
কিন্তু, জলহস্তী তো দিনের অন্তত আঠারো ঘণ্টাই ডুবে থাকে জলে। দিনের চড়া আলোয় ডাঙায় থাকলে তার চর্বিবহুল চামড়ায় টান ধরতে বাধ্য। সেই জন্য, দিনের অধিকাংশ সময়ে জলের চেনা চৌহদ্দিতে কাটিয়ে রাতটুকু তারা বেছে নেয় চারণভূমিতে। চিড়িয়াখানার বন্দি-দশাতেও দর্শককুলের সামনে দিনের অধিকাংশ সময় জলে হাবুডুবু খাওয়ার পরে রাতটুকু তারা ঘুরে বেড়ায় এনক্লোজারের অপরিসর চৌহদ্দিতে। আপাতত সে সুযোগে দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে ওই ছোট্ট জলহস্তিনীর। |
দিনরাত এক করে চলছে চৌবাচ্চা সাফাইয়ের কাজ। শুভাশিস ভট্টাচার্যের তোলা ছবি। |
ভাদ্রের কলকাতায়, এমন চড়চড়ে রোদ্দুরে টানা চার-পাঁচটা দিন এ ভাবে জল-ছাড়া থাকা সম্ভব? পরিচিত জলহস্তী বিশেষজ্ঞ এরিক হেল্বস বলছেন, “খুবই সমস্যা। শুনেছি বছর ছয়েক বয়স ওই শাবকটির। এই বয়সে এতগুলো দিন জলে নামতে না পারলে চামড়ায় টান ধরে ঘা হতে পারে তার। জলহস্তীর নাসারন্ধ্রে খুব পাতলা একটা আবরণ থাকে। তা শুকিয়ে গেলে ওদের শ্বাস নিতেও খুবই অসুবিধা হয়। যা শুনছি তাতে ওর বেঁচে বর্তে থাকাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।” তিনি জানান, রৌদ্রের আঁচ ঠেকাতে জলহস্তীর দেহ থেকে অবিরাম এক ধরনের রস বা ‘ব্লাড সোয়েট’ নিঃসরণ হয়। জল না পেলে সেই রস নিঃসরণও হ্রাস পায়। শুরু হয় অস্বস্তি। টানা চার-পাঁচ দিন এ অবস্থায় থাকলে শাবকটি অসুস্থ হয়ে পড়তে বাধ্য। মৃত্যুও হতে পারে।
চিড়িয়াখানার অধিকর্তা কানাইলাল ঘোষও স্বীকার করে নিচ্ছেন এ ভাবে জল-হীন হয়ে থাকা ওই জলহস্তী শাবকের পক্ষে খুব ‘স্বাস্থ্যকর’ নয়। তিনি বলেন, “এ ভাবে শাবকটিতে রাখলে ঝুঁকি আছে, অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু উপায় কী। পাপ্পির মৃত্যুর পরে ওই জলাধারটা সাফসুতরো না করতে পারলে সংক্রমণের সম্ভাবনাও রয়েছে। ফলে শাবকটিকে ওখান থেকে সরিয়ে সাফাইয়ের কাজ করতে হচ্ছে।” তিনি জানান, চিড়িয়াখানায় অন্য দু’টি জলহস্তীর জন্য যে এনক্লোজার রয়েছে সেখানে চৌবাচ্চা রয়েছে। কিন্তু শাবকটিকে এখনই দুই পুরুষ জলহস্তীর সঙ্গে রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না তাঁরা।
চিড়িয়াখানার পশু চিকিৎসক দয়ানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ। তিনি বলেন, “এ ভাবে জলহস্তী শাবকটিতে না রাখলেই ভাল হত। আমি নিজে ওর উপরে নজর রাখছি। তবে এখনও অসুস্থতার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি, এটাই ভরসা।”
বেজায় ক্ষুব্ধ ‘পিপল ফর এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অফ অ্যানিমাল’ বা পেটা। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকে চিঠি দিয়ে কলকাতা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে তারা। অভিযোগ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সেন্ট্রাল জু অথরিটির’র কাছেও। দিল্লির ওই সরকারি সংস্থার এক কর্তা বলেন, “কোনও বিকল্প জলের ব্যবস্থা না করে শাবকটিকে খাঁচায় আটকে রাখা হল কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
পাপ্পির মৃত্যুর কারণও সম্প্রতি জানা গিয়েছে। নিছকই ক্ষুদ্রান্তের সমস্যা। মূলত শাকাহারি, জলহস্তীর এ সমস্যা হতেই পারে। কিছু দিন ধরেই হজমের সমস্যা হচ্ছিল তার। মানুষের যেমন হয়, তিন টনের জলহস্তির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হজম না হওয়ায় পেটে বায়ু জমতে থাকে তার। ফলে ক্রমাগত চাপ পড়ছিল হৃদযন্ত্রে। মঙ্গলবার রাতে তা থেকেই আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সে।
প্রাকৃতিক পরিবেশেও জলহস্তীদের এ সমস্যা হয়। সে ক্ষেত্রে তারা ডাঙায় উঠে তাদের নিজস্ব ভেষজ ঔষধির খোঁজ করে। এনক্লোজারে বাঁধানো পরিসরে সে সুযোগও নেই। তবে, এ ব্যাপারে সেন্ট্রাল জু অথরিটির বক্তব্য খুব স্পষ্টপশুপাখিদের এনক্লোজার এমন করতে হবে, যেখানে তারা নিজের চেনা বাসস্থানের আভাস পায়। কলকাতা চিড়িয়াখানার মাত্র ৪৫ একর পরিধিতে জলহস্তীদের জন্য এখন তেমনই এনক্লোজার গড়ার কথা ভাবা হচ্ছে। কানাইবাবু জানান, লেকের পাশে আরও বড় জলাশয় গড়া হবে জলহস্তীদের। তা সুদূর পরিকল্পনা।
তার আগে ছোট্ট শাবকটিকে বাঁচিয়ে দুশ্চিম্তার ভ্রূ-কুঞ্চন মুছতে চায় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। |