তালিকাটা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। চেক প্রজাতন্ত্র থেকে উড়িয়ে আনা হয়েছিল লাল ক্যাঙারু। গত শীতে মারা গিয়েছে তিনটি। দেড় বছরে সেই তালিকায় ঠাঁই হয়েছে জেব্রা, শিম্পাঞ্জি, মারমোসেট বাঁদর, চিতাবাঘ, বিভিন্ন প্রজাতির অন্তত ৩০টি পাখি, ২০টি সাপের। মৃত্যু-মিছিলে শেষ সংযোজন আলিপুর চিড়িয়াখানার পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী জলহস্তী ‘পাপ্পি’।
বুধবার সকালে চিড়িয়াখানার এনক্লোজারের খোলা জলাশয়ে বছর আঠাশের ওই জলহস্তিনীকে ভাসতে দেখা যায়। প্রায় টন তিনেক ওজনের প্রাণীটি শরীরের বেশির ভাগটাই জলে ডুবিয়ে দিনভর আয়েস করত। কদাচিৎ জলের পাড়ে দেখা যেত তাকে। তার ভেসে ওঠার ধরন দেখেই সন্দেহ হয়েছিল চিড়িয়াখানার কর্মীদের। খবর পেয়েই হাজির হয়েছিলেন কর্তারা। তড়িঘড়ি পাপ্পির কন্যা শান্তি আর অন্য দুই জলহস্তী পাপ্পু ও কুটনকে অন্য খাঁচায় সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে বহু চেষ্টায় ক্রেন এনে জল থেকে কোনও রকমে টেনে তুললেও চিড়িয়াখানা লাগোয়া পশু-হাসপাতাল পর্যন্ত আর নিয়ে যাওয়া যায়নি পাপ্পিকে। অগত্যা বিকেলে ওই এনক্লোজারেই শুরু হয় ময়না-তদন্ত। চিড়িয়াখানার অধিকর্তা কানাইলাল ঘোষ বলেন, “ময়না-তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।” |
চিড়িয়াখানায় মৃত সেই জলহস্তিনী। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র |
কিন্তু আঠাশ বছরে জলহস্তিনীর মৃত্যু কি খুব স্বাভাবিক? আলিপুর চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ অবশ্য এর মধ্যে কোনও ‘অস্বাভাবিকতা’ দেখছেন না। কানাইলালবাবু বলেন, “সাধারণত জলহস্তীরা বছর ৩০ বাঁচে। পাপ্পির বয়স হয়েছিল ২৮।” তবে চিড়িয়াখানা-কর্তৃপক্ষ এই দাবি করলেও জলহস্তীদের গড় আয়ু সাধারণত ৪০-৫০ বছর। প্রাণী-বিশেষজ্ঞদের এমনই মত। চিনের সাংহাই চিড়িয়াখানায় একটি জলহস্তীর ৬৪ বছরেও দর্শকদের দিব্যি দর্শন দেওয়ার নজির রয়েছে। জার্মানির মিউনিখ শহরের চিড়িয়াখানায় একটি জলহস্তীর আয়ুষ্কাল ছিল ৬১ বছর। ১৯৯৫ সালে মারা যায় সে। আমেরিকার ইভান্সভিলের মেসকার পার্ক চিড়িয়াখানায় ২০১২ সালের ১ অগস্ট ৬০ বছর বয়সে যে জলহস্তিনীটি মারা যায়, তার নাম ছিল ডোন্না। বর্তমানে ৫৮ বছর বয়সে ক্লেভল্যান্ড মেট্রোপার্কস চিড়িয়াখানায় অবসর জীবন কাটাচ্ছে ব্ল্যাকি।
তা হলে মাত্র ২৮ বছরে ‘বয়সজনিত’ কারণে মৃত্যু বলা যায় কি? চিড়িয়াখানার যে এনক্লোজারে অন্য তিন সঙ্গীর সঙ্গে থাকত পাপ্পি, সেখানে জলে কোনও রকম বিষক্রিয়া হয়নি তো?
চিড়িয়াখানার এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাকেশ সিংহের অভিযোগ, “যে জলাশয়ে জলহস্তীরা রয়েছে, গত সাত-আট বছরে তার জল পাল্টানো হয়নি। নোংরা কর্দমাক্ত জল, এত গন্ধ যে কাছে যাওয়া মুশকিল। বারবার বলেও কোনও কাজ হয়নি। অবহেলার ফলেই মারা গেল অতবড় প্রাণীটি।”
যদিও এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে কানাইলালবাবু বলেন, “রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিতই হয়। জলহস্তীরা জলের মধ্যেই যাবতীয় প্রাকৃতিক কাজ করে। এটাই ওদের রীতি। ওই ধরনের জলেই ওরা স্বচ্ছন্দ। বরং ডাঙায় তুললে তাদের জল দিয়ে গা ভিজিয়ে রাখতে হয়। না হলে চামড়া ফেটে যায়।”
২০০৫ সালে মুম্বই থেকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়েছিল পাপ্পিকে। ১৯৮৬ সালে জন্মানো জলহস্তিনীটির তখন প্রাপ্তবয়স। পরের বছরেই তার একটি মেয়ে হয়। নাম রাখা হয় শান্তি। মা-মেয়ে আলিপুর চিড়িয়াখানার দর্শকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তাদের সঙ্গেই থাকত অন্য দুই পুরুষ জলহস্তী পাপ্পু ও কুটন। তাদের সঙ্গে বিবাদেই মারা গেল না তো পাপ্পি?
আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি জঙ্গলে জলহস্তীদের নিয়ে কাজ করছেন এরিক হেল্বস। তিনি জানান, প্রজননকালে কিংবা দলের প্রজননক্ষম জলহস্তিনীর জন্য পুরুষ জলহস্তীদের মধ্যে মারামারির নজির রয়েছে বিস্তর। সেই বিবাদ অনেক সময়েই মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু তা বলে জলহস্তিনীকে আক্রমণের নজির বিশেষ নেই। চিড়িয়াখানার পশু চিকিৎসকেরাও জানান, আপাত ভাবে পাপ্পির শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। তবে, বুধবার সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পাপ্পির নিথর দেহ জলে ভাসতে দেখে দড়ি দিয়ে টেনে যখন তোলা হয়, তখন তার মুখ থেকে রক্ত ঝরছিল বলে জানিয়েছেন চিড়িয়াখানার কর্মীরা। রহস্য তৈরি হয়েছে তা নিয়েই। |