কিশোরীর দেহের উপর অধিকার কাহার? তাহার নিজের, না কি রাষ্ট্রের? সম্প্রতি দিল্লির একটি আদালতে এই প্রশ্নটি উঠিল। কেন কিশোর-কিশোরীদের যৌনসম্পর্কের ইচ্ছাকে পুলিশ-আদালত ‘অপরাধ’ বলিয়া গণ্য করিবে, এই প্রশ্ন স্বস্তিদায়ক নহে। সকল প্রাপ্তবয়স্কই জানেন, অষ্টাদশ বৎসর অতিক্রম করিয়া যৌনচেতনা জন্মায় না, তাহার উন্মেষ প্রথম কৈশোরে, মতান্তরে তাহারও পূর্বে। বিশেষত বয়ঃসন্ধিকালেই নিজেকে কাঙ্ক্ষিত মনে করিয়া রোমাঞ্চিত হইবার সূচনা। কিন্তু গত মার্চ মাসে যৌন নির্যাতন হইতে শিশুদের সুরক্ষার যে আইনটি পাশ করিয়াছে সংসদ, তাহা নারী বা পুরুষকে আঠারো বৎসরের পূর্বে যৌন সংসর্গে সম্মতির অধিকার দেয় নাই। এই সতর্কতা অপ্রয়োজনীয় নহে। ভারতে নাবালিকার বিবাহ, নাবালিকা পাচার এবং বালকবালিকাদের দেহব্যবসায়ে বাধ্য করিবার ঘটনা ব্যাপক। আত্মীয়-প্রতিবেশীদের দ্বারা যৌন নিগ্রহের ঘটনাও কম নহে। পিঙ্কি ভিরানির গবেষণাগ্রন্থ ‘বিটার চকোলেট,’ তসলিমা নাসরিনের স্মৃতিকথা ‘আমার মেয়েবেলা’ কিংবা মীরা নায়ারের ছবি ‘আ মনসুন ওয়েডিং’ শিশুদের যৌন নিগ্রহের তিক্ত-তীব্র ছবি তুলিয়া ধরিয়াছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর সর্বশেষ রিপোর্টে (২০১২) সাড়ে আট হাজারেরও অধিক শিশু ধর্ষণের অভিযোগ রহিয়াছে। এই পরিস্থিতিতে কঠোর আইনের দাবি তুলিয়াছিলেন সমাজকর্মীরা। কিশোরীর সম্মতিতে তাহার বিবাহ হইয়াছে, কিংবা তাহাকে ‘কাজের জন্য’ অন্যত্র পাঠানো হইয়াছে, এই অজুহাতে অব্যাহতির ফাঁকটি তাহারা বন্ধ করিতে চাহিয়াছেন। ফলে সম্মতির পরিসরটিই প্রায় বন্ধ হইয়াছে আইনে।
কিন্তু তাহাতে অন্য প্রকার অন্যায় ঘটিতেছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলিল আদালত। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণয়ন হইলেও, কোনও একটি বিশেষ ক্ষেত্রে তাহার নির্বিচার প্রয়োগ ন্যায়ের পরিপন্থী কি না, তাহাই আদালত বিচার করে। এ ক্ষেত্রে ১৫ বৎসরের এক কিশোরী ২২ বৎসরের একটি যুবককে ভালবাসিয়া বাড়ি ছাড়িবার পর তাহাদের সম্পর্ক ও বিবাহের ঘটনাকে ‘অপহরণ ও ধর্ষণ’ বলিয়া ধরিতে রাজি হয়নি আদালত। বিচারক ধর্মেশ শর্মা বলিয়াছেন, অকালবিবাহ প্রতিরোধ অবশ্যই করিতে হইবে; কিন্তু আঠারো বৎসরের নীচে যৌন সম্পর্ক ঘটিলেই তাহা ধর্ষণ, আইনের এই ব্যাখ্যা করিলে তাহার অর্থ দাঁড়ায়, সকল কিশোরকিশোরীর দেহ বস্তুত রাষ্ট্রের সম্পত্তি, এবং তাহাদের দেহ-সম্পর্কিত আনন্দ অনুভব নিষিদ্ধ। ভারতে কোনও বিচারকের এমন বক্তব্য নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী।
অপরের দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার এক প্রধান প্রকাশ। রাষ্ট্র আইনের বলে নাগরিকদের বন্দি করিতে, এমনকী প্রাণনাশও করিতে পারে। কমিউনিস্ট চিনের মতো কোনও কোনও দেশ নাগরিকদের প্রজনন ক্ষমতাও কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে। ভারতে ব্রিটিশ আমলে আইন অতি-বালিকাদেরও স্বামী-সংসর্গে বাধ্য করিত। আজ বিধিনির্দিষ্ট বয়সের পূর্বে যৌনসংসর্গ অপরাধ, অথচ বিবাহের পরে স্বামীর দ্বারা যৌননির্যাতন ‘ধর্ষণ’ বলিয়া গণ্য নহে। কোনও ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের চক্ষে মেয়েটির ইচ্ছা, তাহার দেহের উপর তাহার অধিকার, গুরুত্ব পায় নাই। ভারতীয় রাষ্ট্রের পুরুষতান্ত্রিকতার নিকট ইহাই স্বাভাবিক, কারণ নিরাপত্তার অছিলায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করিতেই রাষ্ট্র অভ্যস্ত। সেই নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্ন করিলে দুষ্কৃতীরা সুবিধা পাইবে কি না, তাহা একমাত্র বিচার্য নহে। তরুণতরুণীদের দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ কার, এই প্রশ্ন করিয়া বিচারক ধর্মেশ শর্মা একটি অতি-প্রয়োজনীয় বিতর্ক তুলিয়াছেন। |