সুরবেক বিশ্বাসের লেখা ‘আট দশকের সঙ্গী এবার অবসরের পথে’ (২৬-৭) প্রতিবেদনটিতে কলকাতা পুলিশ ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস ও কারিগরি পরম্পরার কিছু বিবরণ ওই লেখায় নেই। তাই আগ্নেয়াস্ত্র শনাক্তকরণ ও বিবর্তনের ইতিহাসের পাঠক হিসেবে কিছু তথ্য সংযোজন করছি।
লর্ড ময়রার আমলে (১৮১৩-১৮২৩) জারি করা ১৮১৬-র রেগুলেশন XVII এবং ১৮১৭-র ৭ অক্টোবর জারি করা রেগুলেশন XX নির্দেশ দু’টি থেকে জানা যায়, ১৮১৬-য় পুলিশের অস্ত্র ছিল বল্লম, তরোয়াল, ঢাল এবং ‘ম্যাচ লক’ শ্রেণির গাদা বন্দুক। আলোচ্য লেখাটির সঙ্গে ছবিতে দেখানো ছুরি বা দোনলা গাদা বন্দুক পুলিশ কখনও ব্যবহার করেছে, এমন কোনও প্রমাণ নেই। ‘ম্যাচ লক’ শ্রেণির গাদা বন্দুক কলকাতা পুলিশের প্রথম আগ্নেয়াস্ত্র। এই ‘ম্যাচ লক’ প্রযুক্তি শুরু হয়েছিল ১৪৫০-এ। বন্দুকের ট্রিগার টিপলে জ্বলন্ত পলতে লাগান অংশটি এগিয়ে এসে নলের গোড়ায় বারুদে আগুন দিত। যে কোনও নতুন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে প্রচলিত হয়ে কিছু বছর ব্যবহার করার পর বাতিল হলে (মোটামুটি ৩-৭ বছর) সেই আগ্নেয়াস্ত্র পুলিশের হাতে আসত। |
‘ম্যাচ লক’-এর পর এল ‘ফ্লিন্ট লক’ শ্রেণির গাদা বন্দুক ‘ব্রাউন বেস মাস্কেট’। এর ট্রিগার টিপলে ঘোড়ায় লাগান চকমকি পাথর ইস্পাতের পাতে আঘাত করলে সেই ফুলকিতে নলের বারুদে আগুন লাগত। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এটি ছিল ১৭৩০-১৮৫৩ পর্যন্ত। এর সাতটি মডেল। ১৭৭৭-এর মডেলটি ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি হয়। পয়েন্ট ৭৫০/৭৮০ ইঞ্চি বোরের এই বন্দুক ভারতীয় পুলিশ ব্যবহৃত দ্বিতীয় আগ্নেয়াস্ত্র। ১৮৫৭-য় ভারতীয় বাহিনীর জন্য কোম্পানি নিয়ে এল উন্নত রাইফেল ‘এনফিল্ড প্যাটার্ন ১৮৫৩, থ্রি ব্যান্ড, ক্যাপ লক, মাজল লোডার রাইফেল’। এর ছিল চারটি মডেল। এরই কার্তুজে চর্বি নিয়ে বিরোধে সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা। এই রাইফেল কিন্তু পুলিশকে দেওয়া হয়নি।
বিদ্রোহের পর ১৮৬১ নাগাদ ভারতীয় সেপাইদের দেওয়া হল ‘পারকাসান ক্যাপ’ শ্রেণির গাদা বন্দুক ‘এনফিল্ড ৫৩ প্যাটার্ন স্মুথ বোর মাস্কেট’, বোর পয়েন্ট ৫৭৭ ইঞ্চি। এটি ভারতীয় পুলিশ ব্যবহৃত তৃতীয় আগ্নেয়াস্ত্র। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে গাদা বন্দুকের যুগ শেষ হল ১৮৬৭-তে। এল ‘সেন্টার ফায়ার’ কার্ট্রিজ ব্যবহারকারী ‘স্নাইডার ব্রিচ লোডার’ বন্দুক। স্নাইডার ভারতীয় পুলিশ পেয়েছিল কি না সে বিষয়ে ধোঁয়াশা আছে। |
১৮৭১-এ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে প্রথম প্রচলিত হল ধাতব কার্ট্রিজ সহ ‘মার্টিনি হেনরি’ রাইফেল। এর চারটি মডেল। কলকাতা পুলিশ বহু দিন এটি ব্যবহার করেছে। এটি তাদের চতুর্থ আগ্নেয়াস্ত্র।
পঞ্চাশের দশকে সেনাবাহিনীর বহু সংখ্যক নং-১ মার্ক-৩ লি এনফিল্ড রাইফেলের নলকে রি-বোর করে, পয়েন্ট ৪১০ ইঞ্চি স্মুথ বোরে পরিবর্তিত করে পুলিশকে দেওয়া হয়। নাম ‘লি এনফিল্ড মাস্কেট’। এর বুলেট ছিল গোল বল। প্রায় ২৫ বছর আগে কলকাতা পুলিশ এই মাস্কেটকে বিদায় জানিয়েছে। এটি কলকাতা পুলিশ ব্যবহৃত পঞ্চম আগ্নেয়াস্ত্র।
১৮৯৫-এ ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তাদের স্ট্যান্ডার্ড রাইফেল হিসেবে নতুন একটি বোল্ট অ্যাকশন রাইফেল নিল। এর ম্যাগাজিনে ১০টি গুলি ধরে আর বোর পয়েন্ট ৩০৩ ইঞ্চি। এর গুলি ছোড়ার কলকব্জার নকশা করেন জেমস প্যারিস লি। এর নলের ভেতর প্যাঁচানো খাঁজ ডিজাইন করেছিল ইংল্যান্ডের এনফিল্ড শহরে অবস্থিত ‘রয়্যাল স্মল আর্মস ফ্যাক্টরি’। এটি ‘লি এনফিল্ড’ নামে পরিচিত। ১৮৯৫-১৯৪৪ পর্যন্ত এর দশটি মডেল ব্রিটিশ সেনারা ব্যবহার করে। এর মধ্যে ‘শর্ট ম্যাগাজিন লি এনফিল্ড নং-১ মার্ক-৩’ রাইফেলটি কলকাতা পুলিশের প্রথম বোল্ট অ্যাকশন ম্যাগাজিন রাইফেল। এটি তাদের ষষ্ঠ আগ্নেয়াস্ত্র, সপ্তমটি ‘শর্ট ম্যাগাজিন লি এনফিল্ড নং-৪ মার্ক-১’ রাইফেল। স্বাধীনতার সময় কলকাতা পুলিশের হাতে ছিল উপরোক্ত দুটি রাইফেল, আর ছিল ‘লি এনফিল্ড মাস্কেট’ এবং ‘মার্টিনি হেনরি রাইফেল’। এ ছাড়া ১৯২৬-এ ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হয়েছিল পুলিশের ট্রেনিং রাইফেল (নং-২ মার্ক-৪)। |
অতএব দেখা গেল বহু ব্যবহারের পর এখন পুলিশের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে একটি নয়, দু’টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল-- লি এনফিল্ড নং-১ মার্ক-৩ এবং লি এনফিল্ড নং-৪ মার্ক-১। আলোচ্য প্রতিবেদনে এই দু’টি একই বোরের কিন্তু আলাদা বিদায়ী রাইফেলের বিষয়ে কোনও উল্লেখ নেই।
কলকাতা পুলিশের বিদায়ী লি এনফিল্ড রাইফেল নং-১ মার্ক-৩ এবং নং-৪ মার্ক-১ দুটিরই কার্যকর পাল্লা বা এফেক্টিভ রেঞ্জ ৩০০ গজ, আলোচ্য প্রতিবেদনে বিবৃত ৫০০ মিটার নয়। কার্ট্রিজ ও বেয়নেট ছাড়া প্রথমটির ওজন ৩.৯১ কেজি এবং দ্বিতীয়টির ৩.৯৯ কেজি, প্রতিবেদনে লেখা ‘৬ কেজি’ নয়। নল থেকে বার হওয়ার সময় এদের ১৭৪ গ্রেন (১১.২৭৫ গ্রাম) ওজনের বুলেটের গতি থাকে ২,৪৪০ ফুট প্রতি সেকেন্ড। বুলেটটি কত দূরে কত জন মানুষকে কী ভাবে বিদ্ধ করবে তা নানা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। বুলেটটি ৫০০ মিটার দূরে তিন জনকে এফোঁড় ওফোঁড় করতে পারে, এটি ভিত্তিহীন উক্তি।
প্রতিবেদনে কলকাতা পুলিশের যে রাইফেলকে ‘এস এল আর’ বলা হয়েছে, তার প্রকৃত নাম রাইফেল ৭.৬২ এম এম ১এ১। কার্ট্রিজ বেয়নেট ছাড়া এর ওজন ৪.৬৯ কেজি, ‘৪ কেজি’ নয়। এর ম্যাগাজিনে ২০টি গুলি থাকে, ৩০টি নয়। এর কার্যকর পাল্লা ৬০০ গজ (৫৪৮.৬৪ মিটার), ৩০০ মিটার নয়। ভারতীয় সেনা প্রায় দশ বছর আগেই এই ‘এস এল আর’ রাইফেলকে বিদায় জানিয়ে ‘ইনসাস’ বা ‘ইন্ডিয়ান স্মল আর্মস সিস্টেম’ রাইফেল নিয়েছে, যা কলকাতা পুলিশও এখন সীমিত ভাবে ব্যবহার করে। |