১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁহার আর্থিক সংস্কারের নীতিগুলি ঘোষণা করিবার পরে দেশের বাম মনোভাবাপন্ন অর্থনীতিবিদরা অনেকে একটি প্রতিবাদপত্র রচনা করিয়াছিলেন। তাহাতে জনকল্যাণে সরকারি কার্যক্রমের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে অনেক সারগর্ভ কথা ছিল। কথিত আছে, সেই সন্দর্ভ পাঠ করিয়া মনমোহন বলিয়াছিলেন, সবই বোঝা গেল, কিন্তু যে বিপুল আর্থিক ঘাটতি তৈয়ারি হইয়াছে, তাহা কী উপায়ে পূরণ করা সম্ভব, সেই বিষয়ে তো প্রাজ্ঞ সমালোচকগণ কিছু বলেন নাই। এই সুভাষিতাবলি লইয়া আমি কী করিব? প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ শুক্রবার রাজ্যসভায় যে ভাষণটি পাঠ করিয়াছেন, তাহা শুনিয়া বাইশ বছর আগের সেই মন্তব্যটি মনে পড়া স্বাভাবিক। ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম দশ দফা সুভাষিত বিতরণ করিয়াছিলেন, তাহাতে তবু নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যের তালিকা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে সেটুকুও নাই। তাঁহার আশ্বাসবাণীর মর্মার্থ: অর্থনীতির অসুখ সারিয়া গেলে অর্থনীতি ভাল হইয়া যাইবে। কিন্তু অন্তঃসারশূন্যতাই তাঁহার বক্তব্যের একমাত্র দোষ নহে, তাহার সঙ্গে যুক্ত হইয়াছে অনর্থক এবং অশোভন দোষারোপের প্রবণতা। তাঁহার অভিযোগ, বিরোধীরা সংসদের একের পর এক অধিবেশন অচল করায় বহু প্রয়োজনীয় আর্থিক নীতি প্রণয়ন করা যায় নাই, বর্তমান সংকটের পিছনে তাহার অবদান বিস্তর। অর্থাৎ, যত দোষ, অন্যের। দোষ চাপাইবার প্রবণতাটি নূতন নহে— ‘জোটধর্ম’র নামে নালিশ স্মর্তব্য!
বিরোধী দলগুলি, বিশেষত বিজেপি যে সংসদীয় গণতন্ত্রকে সচল রাখিবার জন্য যত্নবান ও সক্রিয়, এমন কথা বলা চলে না। বাস্তবিকই তাহারা দীর্ঘ দিন সংসদ অচল করিয়া রাখিয়াছে— বর্তমান অধিবেশনের কর্মময় পরিবেশটি নিতান্ত ব্যতিক্রম। কিন্তু বিরোধী দলগুলিকে সঙ্গে লইয়া এবং তাহাদের ভিন্নমতকে সম্মান করিয়া উদার বহুপাক্ষিক শাসনতন্ত্র পরিচালনার দায়িত্ব শাসক গোষ্ঠীকেই পালন করিতে হয়। মনমোহন সিংহ শরিকদের দৌরাত্ম্য যে অনুপাতে মানিয়া লইয়াছেন, বিরোধীদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদানে তাহার সিকিভাগও তৎপর হন নাই। বস্তুত, শুক্রবার তিনি যে ভাবে বিরোধীদের আক্রমণ করিয়াছেন, তাহা বহুপাক্ষিকতার সম্ভাবনাকে সমূল বিনাশ করিবার পক্ষে যথেষ্ট। পণ্য ও পরিষেবা কর বা পেনশন সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিরোধীদের সহযোগিতা যদি তাঁহার দরকারই হয়, তবে সংসদীয় ভাষণে এমন অনর্থক ‘যুদ্ধং দেহি’ ভঙ্গি কেন? প্রধানমন্ত্রী তাঁহার নীরবতার জন্য বারংবার সমালোচিত হইয়াছেন। কিন্তু নীরবতার বিপরীত কি কটুভাষণ? আর্থিক সংস্কারের সহজ কাজগুলি সম্পন্ন হইয়াছে, এ বার কঠিন কাজের পালা— প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। সেই কারণেই বিরোধীদের আনুকূল্য জরুরি ছিল।
ঠিক যেমন জরুরি ছিল শিল্পবাণিজ্যের পরিচালকদের সহযোগ। অথচ প্রধানমন্ত্রী সংসদের অধিবেশনে পর পর যে দুইটি আইন-প্রস্তাব পাশ করানোর জন্য তৎপর হইলেন, সেই খাদ্য নিরাপত্তা বিল এবং জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিল দুইটিই বিভিন্ন কারণে উদ্যোগীদের নিরুৎসাহ ও কিছুটা সন্ত্রস্ত করিয়াছে। ইহার প্রধান কারণ, তাঁহাদের ধারণা হইয়াছে যে, এই সরকার জনপ্রিয়তার রসদ জোগাড় করিতেই আগ্রহী, সংস্কারের প্রকৃত তাগিদ তাহার নাই। এই বিল দুইটি পাশ করাইতে যে বিপুল উৎসাহ, আর্থিক সংস্কারের উদ্যোগে তাহার দেখা নাই— বাস্তবটি উদ্যোগ-সহায়ক নহে। অর্থশাস্ত্রবিদ প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, বিনিয়োগ শেষ বিচারে উদ্যোগীদের ধারণা তথা বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। রতন টাটার মতো উদ্যোগী যখন সরাসরি নেতৃত্বের ঘাটতির অভিযোগ আনেন, তখন প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য সৎ এবং তন্নিষ্ঠ আত্মসমীক্ষা। কেন তাঁহাকে বাইশ বছর পূর্বের মনমোহন সিংহের ছায়ামাত্র মনে হইতেছে, সেই উত্তর তাঁহাকেই খুঁজিতে হইবে। |