বিশ্বস্ত সোর্সই ডুবিয়েছে লালবাজারকে
সোর্সের মধ্যেই ফের ভূত!
কুখ্যাত তোলাবাজ গোপাল তিওয়ারি থেকে শুরু করে কড়েয়ার আমিনুল-কাণ্ড নিজেদের ‘সোর্স’ সামলাতে গিয়ে নানা ঘটনায় মুখ পুড়েছে লালবাজারের। সোর্সকে মাথায় তোলার খেসারতও দিতে হয়েছে একাধিক বার। এখন জানা যাচ্ছে, সোর্সেরই দৌলতে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের অপারেশন চিফ ইয়াসিন ভটকলকে মুঠোয় পেয়েও ফস্কেছে কলকাতা পুলিশ।
শুধু তা-ই নয়। এখানে গাফিলতির পরিধি আরও ব্যাপক। গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: সংশ্লিষ্ট সোর্সই ছিল কলকাতায় ইয়াসিনের ‘ট্র্যাভেল ম্যানেজার।’ এ শহরে তার থাকা-খাওয়া বা এজেন্ট-লিঙ্কম্যানদের সঙ্গে মোলাকাতের বন্দোবস্ত তো বটেই, এমনকী তাকে সীমান্ত বাংলাদেশে পাচার করতে সাহায্য করেছিল ওই ব্যক্তি, অপরাধের গলিঘুঁজির গোপন খবর পাওয়ার জন্য যার মুখাপেক্ষী হয়ে ছিল পুলিশ! কিন্তু সে তা ঘুণাক্ষরেও গোয়েন্দাদের কানে তোলেনি। সাড়ে চার বছর আগে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-কে তাদের সোর্সই এ ভাবে ডুবিয়ে ছেড়েছে জেনে কেন্দ্রীয় আইবি-র এক অফিসারের আক্ষেপ, “সোর্স ঠিকঠাক হলে ভটকল তো তখনই ধরা পড়ে যায়! তা হলে গোটা দশেক বিস্ফোরণ থেকে দেশ বাঁচত, শয়ে শয়ে প্রাণহানিও এড়ানো যেত।”
এবং এই বিড়ম্বনাকে অতিরিক্ত সোর্স-নির্ভরতারই মাসুল হিসেবে দেখছেন লালবাজারের একাংশ। যে প্রসঙ্গে ‘নজির’ হয়ে উঠে আসছে গোপাল তিওয়ারির নাম। এই মহলের মতে, সোর্স-কে প্রশ্রয় দেওয়া কাকে বলে, বছর পনেরো আগে গোপালের ক্ষেত্রে তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন এক আইপিএস অফিসার। কী রকম?
পুলিশ-সূত্রের খবর: কুখ্যাত তোলাবাজ ও অপহরণকারী গোপাল তিওয়ারি তখন রাজস্থান থেকে কলকাতায় এসে অপরাধ করে গা ঢাকা দিচ্ছে। গোয়েন্দারা হন্যে। বার বার নাগাল ফস্কানোর পরে তাঁদের সন্দেহ হল, কলকাতার বুকে নিশ্চয়ই গোপালের সুরক্ষিত কোনও ডেরা আছে। তদন্ত করতে করতে ডেরার হদিস যখন মিলল, পুলিশ থ। দেখা গেল, ডিসি পদমর্যাদার ওই আইপিএস অফিসার নিজের সাভের্ন্টস কোয়ার্টার্সের চিলেকোঠায় গোপালকে আশ্রয় দিয়েছেন! কারণ, গোপাল তাঁর ‘সোর্স।’ বন্দর-এলাকার দুষ্কৃতী চিকনা অনিল ও তার এক শাগরেদকে নিকেশ করতে তাঁকে সাহায্য করেছিল গোপাল। আবার এ বছরের গোড়ায় কড়েয়ার যুবক আমিনুল ইসলামের আত্মাহুতির ঘটনার পিছনেও সোর্স-কে আড়াল করার অভিযোগ। স্থানীয় দুই কিশোরীকে ধর্ষণের জন্য যার দিকে আমিনুল আঙুল তুলেছিলেন, সেই শাহজাদা বক্স ছিল কড়েয়া থানার সোর্স। যে কারণে পুলিশ আমিনুলের নালিশকে গুরুত্ব তো দেয়ইনি, উল্টে তাঁকেই মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন আমিনুল।
প্রতিকার না-পেয়ে আমিনুল শেষমেশ থানার সামনে গায়ে আগুন দেন। মাসখানেক বাদে তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনাটি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হয়েছে। আদালতে পুলিশকে বিচারপতির ভর্ৎসনাও শুনতে হয়েছে। ইয়াসিন ভটকলের ক্ষেত্রে ঠিক কী হয়েছিল?
লালবাজারের তথ্য অনুযায়ী, সেটা ২০০৯-এর গোড়ার কথা। ইয়াসিন ভটকল নামটার সঙ্গে পুলিশ তখনও সে ভাবে পরিচিত নয়। এক দিন এসটিএফে আইবি-র এক বার্তা আসে। বক্তব্য: মহম্মদ আহমেদ জারার সিদ্দিবাপ্পা (ইয়াসিনের পিতৃদত্ত নাম) নামে এক সন্দেহভাজন বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় ঘন ঘন যাতায়াত করছে, এবং সে ঘাঁটি গেড়েছে কলকাতা পুলিশ সদরের অদূরে, বৌবাজার থানা এলাকায়। ভারতে ২০০৭-২০০৮-এর কয়েকটি জঙ্গি নাশকতায় তার ভূমিকা থেকে থাকতে পারে বলে বার্তায় জানানো হয়।
কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ (এসবি)-ও বার্তাটি পায়। কিন্তু তারা সিদ্দিবাপ্পা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কেননা এসটিএফ তত দিনে পুরোদমে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এসটিএফের বিভিন্ন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারেরা ‘সোর্স’ রেখে ফলও পাচ্ছেন। বিশেষত বৌবাজারেরই এক সোর্স মারফত সদ্য বেশ ক’জন জাল নোট-কারবারি বমাল তাঁদের হাতে এসেছে, হদিস মিলেছে কিছু জঙ্গি-লিঙ্কম্যানের। পুলিশ-সূত্রের খবর, এক আইপিএস অফিসারের ‘বিশ্বাসভাজন’ ওই সোর্সকে তখন লালবাজারে ঘন ঘন দেখা যেত। এসটিএফের এক ইন্সপেক্টরের সঙ্গেও তার দহরম-মহরম ছিল সুবিদিত।
অথচ এ হেন আস্থাভাজন সোর্স অফিসারদের কাছে বেমালুম চেপে গিয়েছিল যে, নিয়মিত চোরাপথে কলকাতা-বাংলাদেশ যাতায়াতকারী এক ব্যক্তিকে সে নিজেই আশ্রয় দিয়েছে। পুলিশ-ঘনিষ্ঠ সোর্স জঙ্গি চাঁইয়ের আশ্রয়দাতা, এটা কর্তারাও ভাবেননি। লালবাজার-সূত্রে জানা যাচ্ছে, এসটিএফের কিছু কর্তা ওকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে, সিদ্দিবাপ্পা সম্পর্কে তার মুখে কোনও খবর না-মেলায় আইবি-র বার্তাটিকে নিছক ‘রুটিন অ্যালার্ট’ ঠাউরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু ‘বিশ্বস্ত’ সোর্স এমন কাজ করল কেন?
পুলিশ-কর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা: সোর্স নিজেও তখন জানত না যে, শহরে সে যার থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে, সে আসলে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের মাথা। এসটিএফ পরে খোঁজ-খবর নিয়ে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে বলে লালবাজারের কিছু কর্তার দাবি। তাঁরা বলছেন, এই কারণেই প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তার বিরুদ্ধে কোনও মামলা রুজু করা হয়নি। যদিও গোয়েন্দা-অফিসারদের একাংশ ব্যাখ্যাটির সঙ্গে পুরোপুরি সহমত নন। বরং তাঁদের কেউ কেউ মনে করছেন, লোকটি যেটুকু জানত, সেটুকুই তখন এসটিএফের কানে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। “বাংলাদেশ-কলকাতা ঘন ঘন যাতায়াত করছে, এমন কাউকে আশ্রয় দেওয়ার সংবাদ সোর্স গোপন করে গেল, এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আসলে কিছু অফিসারই ওকে মাথায় তুলেছিলেন। তাই ও সাহসটা পেয়েছিল।” মন্তব্য এক অফিসারের।
আর এ প্রসঙ্গেই সোর্স-সুরক্ষার ‘সীমারেখা’ ঘিরে বিতর্ক ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে। লালবাজারের এক অফিসার বলছেন, “এটা ঠিক যে, অন্ধকার জগতের খবর সাধুসন্তের কাছে পাওয়া যাবে না। পুলিশকে সোর্স রাখতেই হবে। তবে সোর্সকে কতটা স্বাধীনতা দেব, কিংবা তার কুকীর্তি কতটা বরদাস্ত করব, সেই মাত্রাজ্ঞানও সমান জরুরি।”
নাকের ডগায় বসে থাকা ইয়াসিন ভটকলের নাগাল ফস্কানোই এর প্রমাণ বলে মনে করছেন গোয়েন্দা-কর্তাদের অনেকে।

পুরনো খবর:
ন্যাটোর বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিল ভটকল, দাবি
ইয়াসিন ভটকল ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিল বলে দাবি গোয়েন্দাদের। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮। সম্প্রতি ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের জঙ্গি ইয়াসিনকে ভারত-নেপাল সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, ইয়াসিন ২০১১-এ দিল্লিতে একটি পুরোদস্তুর অস্ত্র কারখানা তৈরি করেছিল। তাতে রকেট লঞ্চার ও লাইট মেশিনগান তৈরির ব্যবস্থা ছিল। তৈরি হত গোলাগুলিও। ২০১১ সালের নভেম্বরে সেটির সন্ধান পায় দিল্লি পুলিশ। আপাতত তেহসিন নামে এক ব্যক্তির খোঁজ করতে ব্যস্ত গোয়েন্দারা। ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের ভারতে কার্যকলাপের ক্ষেত্রে ইয়াসিনের পরে সে-ই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে মনে করছেন তাঁরা। তেহসিন ভারতেই রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনআইএ) সূত্রে খবর। ইয়াসিন বিহারে জঙ্গি নেটওয়ার্ক চালালেও কেন নীতীশ কুমার সরকার তার বিরুদ্ধে এফআইআর করেনি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলল বিজেপি। গ্রেফতারির পরে ভটকলের বিরুদ্ধে এফআইআর করে এনআইএ। বিজেপি মুখপাত্রের বক্তব্য, “বিহার পুলিশ ভটকলকে জেরাও করেনি। অথচ বিহারে তার নেটওয়ার্ক ছিল। নীতীশ সরকার কেন এই পদক্ষেপ করল তা জানার অধিকার বিহারের মানুষের আছে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.