মাত্র চব্বিশ দিন আগেই জম্মু-কাশ্মীর সীমান্ত অঞ্চল পুঞ্চে পাক সেনার গুলিতে মারা গিয়েছে পাঁচ ভারতীয় জওয়ান।
নিরন্তর লেগে থাকা ভারত-পাক সীমানা সমস্যার টানটান উত্তেজনার মধ্যে সাম্প্রতিক কালের সবথেকে বড় ঘটনা অবশ্য ’৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধ।
চোদ্দো বছর আগে কার্গিলে দেড়শোরও বেশি সেনা মারা যাওয়ার স্মৃতি এখনও টাটকা সুনীল ছেত্রীর কাছে।
কারণ মেহতাব-রহিম নবিদের মতো জাতীয়তাবাদের আবেগের জন্য নয়, ভারত অধিনায়কের বাবা কে বি ছেত্রী স্বয়ং কার্গিলে গিয়ে লড়াই করেছিলেন মেজরের উর্দি পরে। শনিবার সকালে যখন উইম কোভারম্যান্সের টিম অনুশীলনের পর টিম বাস থেকে নেমে হোটেলে ঢুকছে, তখন পাশ দিয়ে ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছিলেন হাসান বসির, ইয়াকুব বাটরা। সে দিকে তাকিয়েই স্বগতোক্তির মতো সুনীলকে বলতে শোনা গেল, “আমার বাবা কার্গিল যুদ্ধে গিয়েছিলেন দেশকে রক্ষা করতে। আমার কাছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মাঠে নামা মানেই ফাইনাল খেলতে নামা।”
ক্রিকেটে ভারত-পাক লড়াই হলেই স্টেডিয়ামগুলোয় ভিড় উপচে পড়ে। ভারতীয়রা ভিড় করেন ‘যুদ্ধ’ জেতার উত্তেজনা পোহাতে।
দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মীররঞ্জন নেগীদের সেই সাত গোলে হারের লজ্জার বদলা নিয়েছিল ভারতীয় হকি দল। ম্যাচের পর দেখা গিয়েছিল খেলা দেখতে আসা স্বয়ং মনমোহন সিংহ, সোনিয়া গাঁধীদের মাঠে নেমে ভরত ছেত্রীদের অভিনন্দন জানাতে।
ভারত-পাক খেলা যে মুলুকেই হোক, তা সে শ্রীলঙ্কা বা শারজা সব সময়ই সেটা হাইভোল্টেজ। ধুন্ধুমার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। খেলার চেয়েও যা ঘিরে তৈরি হয় আবেগ আর উত্তেজনার বিস্ফোরণ। ম্যাচ জেতায় মানসিক জোর, বুকের কলজে। নেপাল সেই উত্তেজনার লাভাস্রোত থেকে দূরে থাকবে তা হয় না কি? যেখানে আবার প্রেক্ষাপট সম্প্রতি কাশ্মীরে দু’দেশের গুলির লড়াই। যার জেরে এ মাসের গোড়ায় ভারতীয় জওয়ানদের পাঁচটি কফিন এসেছে পুঞ্চ থেকে।
নয় নম্বর সাফে খেলতে আসা দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ উত্তেজক যুদ্ধে নামার আগে অবশ্য রয়েছে এক ছাউনিতেই অর্থাৎ এক হোটেলে। |
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। শনিবার কাঠমান্ডুতে ভারতীয় ফুটবল দল। ছবি: এআইএফএফ |
“বর্ডার সমস্যা বা রাজনৈতিক লড়াই নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। এখানে ফুটবল নিয়েই যা বলার বলব। ট্রফিটা নিয়ে যেতে এসেছি। তবে এটা বুঝে গিয়েছি এই ম্যাচটা সব সময়ই স্পেশ্যাল,” কোভারম্যান্স কিছু না বলেও বলে দেন অনেক কিছু। সুদূর নেদারল্যান্ডস থেকে এসেছেন। এর বাইরে বলবেনই বা কী?
আর পুরো টিমকে গোয়েন্দার চোখ দিয়ে আটকে রেখেও পাক কোচ সাহাজাদ আনোয়ারের মন্তব্য, “আমি চাই ভারত-পাক সিরিজ হোক। যাতে উত্তেজনা কমে। তবে এটা ঘটনা ভারতের বিরুদ্ধে খেলতে নামলে আমাদের সবার মধ্যে কেমন যেন একটা অন্য রকম অনুভূতি হয়। কালকের ম্যাচ কিন্তু ফিফটি-ফিফটি।”
দুই কোচের মুখ এবং মুখোশ অবশ্য মালুম হয়, যখন খাবার টেবলেও ফুটবলারদের উপর তীক্ষ্ন নজর রাখে পাকিস্তান। দু’দলেই কথা বলার উপর জারি করা হয় নিষেধাজ্ঞা। হয় ক্লোজড ডোর অনুশীলন।
কোচেরা প্রকাশ্যে ফুটবলারদের মতো উত্তেজিত হবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কাঠমান্ডু এই ম্যাচ শুরুর আগেই যে কেঁপে উঠেছে! যার প্রভাবে শুক্রবার মাঝরাতে ভারত এবং পাক দুটি দলকেই হোটেল ছেড়ে নেমে আসতে হয়েছিল রাস্তায়। শেষ পর্যন্ত ‘সমস্যা নেই’ আশ্বাস পেয়ে হোটেলের ঘরে নিশ্চিন্তে ফেরেন সুব্রত পাল, লেনি, নির্মলরা।
নেপাল জুড়ে এ দিন রাতে তীব্র ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে যার পরিমাপ ৬। সবথেকে বেশি ভূকম্প হয় কাঠমান্ডুতেই। এতটাই যে, বাংলাদেশের এক ফুটবলার হোটেলের খাট থেকে মাটিতে পড়ে যান। খাট ও ঘর কাঁপছে দেখে সাফে খেলতে আসা সব প্রায় টিমই ভয়ে দৌড়ে ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। বহু হোটেল-বাড়িরও ক্ষতি হয়েছে। নেপালের লোকজনদের মধ্যে অবশ্য হেলদোল নেই। কারণ এটা তাদের গা সওয়া।
কিন্তু রাতের ভূমিকম্প যে ’৯৯-এর ইউরো জয়ী ডাচ দলের সদস্যকে রীতিমতো চমকে দিয়েছে সেটা শনিবার সকালে কোভারম্যান্সের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে স্পষ্ট। আপনার টিম কি কাল দশরথ স্টেডিয়ামে ভূমিকম্প ঘটাতে পারবে? ভারতীয় কোচ মজা করে কোমর দুলিয়ে রাতের অভিজ্ঞতা দেখানোর পর বলে দিলেন, “কাল মাঠে এ রকম হোক চাই না। তবে ম্যাচটা জিততে চাই। এবং আমরা তৈরি।”
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ট্র্যাক রেকর্ড বেশ ভাল। ৩০টি ম্যাচের ১৭টিতে জিতেছে ভারত। পাকিস্তানের জয় ৫টি। লাহৌরে পাকিস্তানের মাটিতে ২০০৫-এর সাফের সেই চমকপ্রদ জয় এখনও মনে রেখেছেন সেই দলের তিন সদস্য সন্দীপ নন্দী, মেহতাব হোসেন এবং রহিম নবি। সেই নবি এ দিন বলছিলেন, “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমিই মনে হয় সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছি। ন’টা। ওদের বিরুদ্ধে জিতলে মনে হয় সত্যিই দেশের জন্য একটা ম্যাচ জিতলাম। সব সময় একটা আলাদা উত্তেজনা অনুভব করি। তবে এ বারের পাকিস্তান কিন্তু প্রচণ্ড শক্তিশালী।” পাক টিমের বিরুদ্ধে দু’বার খেলে দু’বার জিতেছেন সুব্রত পাল। সুব্রত-র মতো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দারুণ সফল জেজেও। দু’ম্যাচে পাঁচ গোল আছে তাঁর। ঢাকায় শেষ সাফের সাক্ষাতে হাটট্রিক আছে জেজের। কোভারম্যান্স তাঁকে ব্যবহার করছেন ক্লিফোর্ড মিরান্ডার জায়গায়।
আবেগ, মানসিক উত্তেজনা সরিয়ে রাখলে দশরথ স্টেডিয়ামে রবিবাসরীয় সন্ধ্যার লড়াই মূলত হবে ভারতের স্কিলের সঙ্গে পাক-শক্তির। পাকিস্তান এখানে যে টিম এনেছে ধারে-ভারে তা যথেষ্ট কার্যকর। সবথেকে বড় কথা ফুটবলারদের গড় উচ্চতা চোখে পড়ার মতো-- ছয় ফুট। শুধু তাই নয়, ডেনমার্কে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডিভিশনে খেলা পাক-জাত চার ফুটবলার আছেন দলে। এখানেই শেষ নয়, ফুলহ্যামে খেলা জইস রহমান এসেছেন শুধু ভারতকে হারাতে। এ বারের সাফে ডিফেন্ডার জইস-ই সবথেকে হাইপ্রোফাইল ফুটবলার। তাঁর বর্তমান ক্লাব সিঙ্গাপুরের কিটচি বলেছিল, ৩ সেপ্টেম্বরের আগে ছাড়া যাবে না। কিন্তু জইস ক্লাবকে বলে দেন, “ভারতের বিরুদ্ধে খেলতে না পারলে, গিয়ে কোনও লাভ নেই। চুক্তি ভেঙে হলেও যাব। এখন আমাকে দেশের দরকার।”
সুনীল-নবিরা তো তেতে। কিন্তু কেমন মনোভাব নিয়ে কাল নামবে পাকিস্তান। ডেনমার্কের দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব ফিমেড আমেজারে খেলেন হাসান বসির। পাক স্ট্রাইকার কোচের নজর এড়িয়ে শুধু বললেন, ‘ইনসাল্লা, ট্রফি চাই না। শুধু কালকের ম্যাচটা জিততে চাই।”
শুনে মনে হল তা হলে, যত যুদ্ধ সব সেই কাঠমান্ডুতেই। |
মুখোমুখি ২ প্রতিবেশি |
• সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়
২ অক্টোবর, ২০১০ (সাফ গেমস, ঢাকা)
ভারত ৫ (জেজে-হ্যাটট্রিক, ডিকা, তীর্থঙ্কর)
পাকিস্তান ১
|
• সর্বোচ্চ ব্যবধানে হার
১৮ জুন, ২০০৫ (প্রীতি ম্যাচ, লাহৌর)
পাকিস্তান ৩ : ভারত ০ |
• সর্বোচ্চ গোলদাতা
আই এম বিজয়ন (৯) |
মোট ম্যাচ ২৯ |
ভারত
জয়- ১৭
গোল- ৪৫ |
পাকিস্তান
জয়- ৫
গোল- ২৩ |
• ড্র- ৭
(শেষ ম্যাচ: ২৩ মার্চ, ২০১১ এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ কোয়ালিফাইয়িং রাউন্ড)
ভারত ৩ (জেজে-২, ডায়াস)
পাকিস্তান ০ |
* পরিসংখ্যান: হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় |
আজ খেলায়
সাফ কাপের লড়াইয়ে
ভারত বনাম পাকিস্তান (স্টার স্পোর্টস২, সন্ধে ৬-২৫) |
|