রোববারের কলকাতায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটকের নাম নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন! আর তাঁকে কেন্দ্র করেই ভারতীয় বোর্ডের পঁচাশি বছরের ইতিহাসে কখনও অভিনীত হয়নি, এমন ঘটনা রোববার দুপুরে কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে ঘটতে যাচ্ছে!
শ্রীনিবাসন কি না প্রেসিডেন্ট হয়েও জরুরি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন সাধারণ সদস্যের চেয়ারে! আইনের জটিলতায় এমনই পরিস্থিতি যে শনিবার রাত অবধি ঠিক আছে শ্রীনি বৈঠকে যোগ দেবেন নিছক তামিলনাড়ু ক্রিকেট সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে। সভাপতিত্ব করবেন কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া, যাঁর হাত থেকে কার্যত শ্রীনি সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে ধন্যবাদজ্ঞাপক চিঠিও পাঠিয়ে দিয়েছেন। অথচ পাকেচক্রে এমনই পরিস্থিতি যে ঠিক করতে হয়েছে সভার শুরুতে ‘ওপেনিং রিমার্ক’ পেশ করবেন ডালমিয়া। সদস্যদের বলবেন, আইনের সমস্যার জন্য এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে বোর্ড এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের প্রেসিডেন্টও তাই। আজকের বৈঠকে তাই উনি সভাপতিত্ব করতে পারছেন না। ডালমিয়া নিজে অবশ্য আনন্দবাজারকে বললেন, “প্রেসিডেন্ট কাল সকালে এলে সব কিছু চূড়ান্ত হবে।” কেউ কেউ আবার এমনও জল্পনায় ব্যস্ত যে অরুণ জেটলির তাঁকে সভায় আসা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ মেনে নিয়ে শ্রীনি আসবেনই না।
শ্রীনি-র কলকাতা আসার কথা ছিল শনিবার রাতে। সেই মতো সিএবি তাঁকে বিমানবন্দর থেকে আনার প্রস্তুতিও নিয়েছিল। তার পর বোর্ড প্রেসিডেন্ট নিজেই ফোন করে জানান, তিনি আসবেন রোববার সকালে চার্টার্ড ফ্লাইটে। সাড়ে আটটায় নেমে সোজা হোটেলে চলে যাবেন। তার পর সটান বারোটার বৈঠকে। চেন্নাইয়ে বসে অবশ্য সারা দিনই সক্রিয় থাকল তাঁর সেলফোন। দফায় দফায় আলোচনা চালালেন কখনও বোর্ড কর্তা আর বেশি ভাগ সময়ই আইনজীবীদের সঙ্গে। রাতে প্রবীণ বোর্ড সদস্য বললেন, “ক্রিকেটটা দেশ থেকে উঠে গেছে। ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমি চলছে না। সাউথ আফ্রিকা ট্যুর ফাইনাল হচ্ছে না। এখন শুধু লইয়ার আর লইয়ার।”
আইনজীবী মহলেও রোববারের বোর্ড বৈঠক ঘিরে তীব্র কৌতুহল। ১১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে বোর্ডের মামলার ফের শুনানির দিন। তার আগে অনেকেরই ধারণা ছিল শ্রীনিবাসন কলকাতার বৈঠকে বসবেন না। অথচ শ্রীনি শুধু বসা নয়, প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসে তদারকি করার কথাই ভেবেছিলেন। তাঁকে নিরস্ত করেন আইনজীবী ও বোর্ডের কিছু সদস্য। কনফারেন্স কলে শ্রীনি একইসঙ্গে কথা বলছিলেন অরুণ জেটলি, রাজীব শুক্ল-র সঙ্গে। তাঁরা নাকি পরামর্শ দেন, আপনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে সভায় বসলে একে আদালত অবমাননা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট অত্যন্ত বিরূপ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। তার চেয়ে একটা সমাধানসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় যে সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দিলে সাপও মরে, লাঠিও ভাঙে না। আদালত অবমাননাও হল না। আবার বোর্ডকে যে ভাবে প্রভাবিত করতে চান সেটা করা গেল। কোনও কোনও আইনজীবী তবু শ্রীনিকে বোঝানোর চেষ্টা করে যান, সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দিলেও সেটা আদালত অবমাননা হতে পারে। সেটা শনিবার রাত অবধি তিনি ধর্তব্যের মধ্যে নেননি।
বোর্ডের প্রাক্তন আইনজীবী উষানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন মনে করেন, রোববারে যদি সাধারণ সদস্য হয়েও শ্রীনি সভায় বসেন সেটা পরিষ্কার আদালত অবমাননা হবে। বোর্ডের হয়ে এক সময় অসংখ্য মামলা লড়া উষাবাবুর মতে, “শ্রীনিবাসনকে সরে যেতে হয়েছিল স্পট ফিক্সিং তদন্তের কাজ প্রশস্ত করার জন্য। পরিষ্কার বলা হয়েছিল যতক্ষণ না তদন্ত কমিশনের কাজ সম্পূর্ণ হচ্ছে তত দিন প্রেসিডেন্ট দূরে থাকবেন। সেই সিদ্ধান্ত হয় ২ জুন। এর পর তদন্ত কমিশনের সিদ্ধান্ত বম্বে হাইকোর্ট খারিজ করে দেয়। বোর্ড তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে আজ অবধি স্থগিতাদেশ পায়নি। তার মানে পুরো ‘প্রসেস’ এখনও শেষ হয়নি। তদন্ত এখনও অসমাপ্ত। এই অবস্থায় বোর্ডের বৈঠকে যদি শ্রীনি ফেরত আসেন, সেটা পরিষ্কার তদন্তকে প্রভাবিত করা হবে। বিচারব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখানো হবে।” ভারতীয় ক্রিকেটমহলের খবর অনুযায়ী শ্রীনি কী করেন তা দেখার জন্য বিরোধীপক্ষের আইনজীবীরাও তাকিয়ে আছেন। এমনিতেই রোববারের বৈঠক আইনসিদ্ধ কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বোর্ডের নোটিশে বলা হয়েছে, জরুরি কার্যকরী কমিটির সভা। আর তার মধ্যে রাখা হয়েছে বেশ কিছু অ্যাজেন্ডা। শ্রীনিবাসনকে নাকি অনেক জরুরি চিঠিতে সই করতে হবে। অনেক কিছু আটকে রয়েছে। অথচ বোর্ডের সংবিধান অনুযায়ী, জরুরি কার্যকরী কমিটির সভায় এক বা দু’টো বিষয়ের বেশি নিয়ে আলোচনা করা যায় না। সেটা করা যায় সাধারণ কার্যকরী কমিটির বৈঠকে। কিন্তু এটা তো সাধারণ বৈঠক নয়।
ক্রিকেটমহল শ্রীনির গতিবিধি ছাড়াও দ্বিতীয় আর একটা প্রশ্নের উত্তর পেতে সবচেয়ে উৎসুক। তা হল বার্ষিক নির্বাচনের দিন কলকাতায় ঘোষণা হবে কি না? নাকি শ্রীনির মদতে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে?
এখন যা পরিস্থিতি যদি ২৮ সেপ্টেম্বর অন্য বারের মতো নির্বাচন হয়। আর আগামী সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে শ্রীনি স্থগিতাদেশ না পান। তা হলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারবেন না। তা বোর্ডে যতই তাঁর এখনও সংখ্যাধিক্য থাক।
তা হলে কি কলকাতার বৈঠকে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে? যাতে শ্রীনি সময় পান নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার? রাতে প্রভাবশালী বোর্ড সদস্য বলছিলেন, “এটাই বোর্ডে শ্রীনির শেষ মিটিং কি না ভেবে দেখবেন। ১১ তারিখ স্থগিতাদেশ না পেলে শ্রীনির বোর্ডের কেরিয়ার এক রকম গেল। আর যদি সেটাও পেয়ে যায়, এখনও দিল্লি আর মুম্বই পুলিশ কিন্তু চার্জশিট পেশ করেনি। খেলা এখনও অনেক বাকি। তবে কিস্তিমাতের দিকে এগিয়ে গিয়েছি।”
শীত যদি এসে যায়, বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে? শ্রীনি যখন কলকাতায় তখন তাঁর প্রবলতম প্রতিপক্ষ চলে এসেছেন পটনায়। আর সেখান থেকে নজর রাখছেন পরিস্থিতির ওপর। বম্বে হাইকোর্টে বোর্ড প্রধানের বিরুদ্ধে মামলাজয়ী বিহার ক্রিকেট সংস্থার সচিব আদিত্য বর্মার ধারণা, শ্রীনি চেয়ার করা দূরে থাক। কলকাতার বৈঠকে আসবেনই না। যেখানে ইন্ডিয়া সিমেন্টস এবং তাঁর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট নোটিশ জারি করেছে, সেখানে এত বড় ঝুঁকি তিনি নেবেনই না। মরিয়া শ্রীনি তবু কলকাতা আসার পরিকল্পনা করছেন শুনে আদিত্য বেশ বিস্মিত। ফোনে মনে হল সত্যি হলে বেশ খুশিই হবেন! |