মিনতি বর্মন একা নন। বিধির গেরোয় গর্ভজাত সন্তানকে কাছে পাচ্ছেন না তাঁর মতো আরও অনেক মা। কারণ একটাই ওঁরা মা হয়েছিলেন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায়। সেখানে শিশুদের ঠাঁই হয় না বলে মায়ের থেকে তাদের আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল।
সেই দূরত্ব আর জোড়া লাগেনি। যেমন হয়েছে মাটিগাড়ার বধূ মিনতির ক্ষেত্রে। পাভলভ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন প্রসব করেছিলেন। তবে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায়। বাড়ির লোক নিতে না-আসায় তখনও তাঁর ঠিকানা ছিল ওই হাসপাতাল। কিন্তু সন্তানকে মায়ের সঙ্গে রাখা হয়নি। উল্টে মায়ের অনুমতির তোয়াক্কা না-করে কর্তৃপক্ষ চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি মারফত বাচ্চাটিকে হোমে পাঠিয়ে দেন। পরে মিনতির পরিবার ঘরের বৌকে ঘরে ফেরালেও তাঁর সন্তানকে গ্রহণ করতে চায়নি। সে কোথায় কী ভাবে আছে, মিনতি তা জানেন না।
তাই কার্যত অদেখা ছেলের জন্য চোখের জল ফেলে দিন কাটছে মাটিগাড়ার বধূর। আর তাঁর দুর্ভাগ্যের বৃত্তান্ত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পরে এমন অন্তত ন’টি মা-বিচ্ছিন্ন শিশুর খবর মিলেছে, যাদের জন্ম কলকাতার দু’টি মানসিক হাসপাতালে। কারওরই মায়েদের কোনও রেকর্ড হাসপাতালে মজুত নেই। ফলে পরিবার থাকা সত্ত্বেও ‘অনাথ’ তকমা নিয়ে তারা বড় হচ্ছে নানা হোমে। হোমগুলির পরিচালক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাবি: সংশ্লিষ্ট মানসিক হাসপাতালে যোগাযোগ করে এখন জানা যাচ্ছে যে, বেশ কয়েকটি বাচ্চার মা সুস্থ হয়ে হোম ছেড়েছেন, যে কথা তাদের আগে বলা হয়নি।
বিষয়টিকে অনৈতিক তো বটেই, বেআইনি বলেও অভিহিত করছেন বিভিন্ন হোমের পরিচালকেরা। স্বাস্থ্য-কর্তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন তাঁরা। এ নিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে স্বাস্থ্য-কর্তাদের একটি বৈঠকও হয়ে গিয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহ-অধিকর্তা তাপস নন্দী বলেন, “হাসপাতালগুলোয় খোঁজখবর করা হচ্ছে। রেকর্ড রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বহু ক্ষেত্রে পরিবারই বাচ্চাকে নিতে আগ্রহী হয় না। সেখানে আমাদের কিছু করার নেই।” কিন্তু পাভলভের মিনতি বর্মন সুস্থ হয়ে ওঠা সত্ত্বেও তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে তাঁর সন্তানকে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির হেফাজতে দেওয়া হল কেন?
প্রশ্নটি ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। জনস্বার্থ-মামলাও দায়ের হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারপার্সন মিনতি অধিকারী বলছেন, “মানসিক হাসপাতাল থেকে বহু শিশু আমাদের কাছে আসে। আমরা খতিয়ে দেখছি, মিনতি বর্মনের সন্তানকে সরাসরি আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল নাকি হাসপাতাল তাকে অন্য কোথাও পাঠিয়েছে।” চেয়ারপার্সনের অভিযোগ, অন্য শিশুগুলির মায়েদের সম্পর্কে তাঁরা বারবার তথ্য চাইলেও পাভলভ-কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করছেন না।
স্বাস্থ্য দফতরের খবর, উল্লিখিত ন’টি শিশুর সাতটির জন্ম পাভলভে, দু’টির লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে। লুম্বিনী পার্কে যে মহিলা ওই দুই বাচ্চার জন্ম দিয়েছিলেন, তিনি ছাড়া পেয়ে বিহারে শ্বশুরবাড়িতে চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ঠিকানা হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। আর পাভলভের সাতটি শিশুর পরিচয় সংক্রান্ত কোনও নথিই এই মুহূর্তে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের হাতে নেই!
অথচ স্বাস্থ্য-সূত্রে জানা যাচ্ছে, কোন মায়ের সন্তান কে, এবং তাকে কোথায়, কার হেফাজতে রাখা হচ্ছে, এর বিস্তারিত তথ্য হাসপাতালের রেকর্ডে রাখাটা নিয়ম। ‘রিলিজ’ হওয়া মায়ের ঠিকানাও নথিতে রাখার কথা, যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা সন্তানকে ফেরতে চাইলে জটিলতা তৈরি না হয়। নিয়ম কেন মানা হয়নি?
হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর মেলেনি। পাশাপাশি মিনতি বর্মনের সন্তানকে হোমে পাঠানোর ঘটনাটিকে পাভলভের সুপার রাঘবেশ মজুমদার ‘দস্তুর’ আখ্যা দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে। “কে স্থির করেছে এই দস্তুর? সন্তানকে মায়ের থেকে আলাদা করা তো রাষ্ট্রের অধিকার হতে পারে না! বরং সন্তানকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াটাই রাষ্ট্রের কর্তব্য।” মন্তব্য করেন সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়। তিনি জানান, এর প্রতিবাদে তাঁরা লাগাতার আন্দোলনে নামবেন। একটি হোমের তরফে অমিতা সেন বলেন, “পাভলভে জন্মানো একাধিক শিশু আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা বার বার সুপারের সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। মায়েদের খুঁজে বার করতে চাইছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নাকি সময়ই বার করতে পারছেন না!”
অমিতাদেবী জানাচ্ছেন, লুম্বিনী পার্কে জন্মানো দু’টি শিশুও তাঁদের হেফাজতে বড় হচ্ছিল। ওদের কবে মায়ের কাছে দেওয়া যাবে, তা জানতে তাঁরা হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলেন। তখনই জানা যায়, মাকে অনেক আগে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে! অমিতাদেবীর আক্ষেপ, “বাচ্চাগুলোকে নিরাপদ আশ্রয় দিতে আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। আদতে তো ওদের মায়ের থেকে বরাবরের মতো আলাদা করে দেওয়া হল!”
পরিবার থাকতেও কোনও শিশু অনাথ পরিচয়ে বড় হবে, এটা কি চরম অমানবিকতা নয়? প্রশাসন আপাতত এই প্রশ্নের মুখে। |