হাইকোর্টে ফের ধাক্কা খেল রাজ্য সরকার। এ বার হলদিয়ার বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ নিয়ে।
ওই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিল করে দু’বছর আগে রাজ্য যে নির্দেশ দিয়েছিল, শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্ট তা খারিজ করে দিয়েছে। দু’সপ্তাহের মধ্যে অনুমোদন নবীকরণ করে ওখানে ছাত্রভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য সরকারকে এ দিন নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি নিশিথা মাত্রে ও বিচারপতি কাঞ্চন চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ। পাশাপাশি ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়ে জরিমানাও করেছে রাজ্য সরকার, রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই)-কে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘আইকেয়ার’ পরিচালিত হলদিয়ার বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজটির পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান হলেন প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ লক্ষণ শেঠ। ২০১১-য় পালাবদল ঘটিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় এসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কলেজের অনুমোদন খারিজের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মতো রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর ও রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় হলদিয়া মেডিক্যালের অনুমোদন বাতিল করে। এর পরে মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (এমসিআই)-ও একই পথে হাঁটে। কাউন্সিলের যুক্তি ছিল, ওখানে একই বাড়িতে মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ চালানো হচ্ছে, যা বিধিসম্মত নয়।
রাজ্য সরকার ও এমসিআইয়ের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে কলেজ-কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। নিষ্পত্তির জন্য সেটিকে হাইকোর্টের কাছেই ফিরিয়ে দেয় শীর্ষ আদালত। ইতিমধ্যে হাইকোর্টের নির্দেশে হলদিয়া মেডিক্যালের ছাত্রছাত্রীরা এমবিবিএস প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় বসেন। মূল মামলাটি এত দিন চলছিল।
এ দিন বিচারপতি মাত্রের ডিভিশন বেঞ্চ তার চূড়ান্ত ফয়সালা করে দিয়ে বলেছে, ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নবীকরণ করে ছাত্রভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। প্রসঙ্গত, অনুমোদন রদ হওয়ায় হলদিয়া মেডিক্যালে যেমন এ বার প্রথম বর্ষে পড়ুয়া ভর্তি হতে পারেনি, তেমন প্রথম বর্ষের এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণেরা দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু করতে পারেননি। এ দিকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক ১৫ জুলাই মেডিক্যালে ভর্তির সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছে। তা হলে হলদিয়া মেডিক্যালে ছাত্রভর্তি কী ভাবে সম্ভব?
হাইকোর্ট এ দিন সেটাও পরিষ্কার করে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য: কোনও মামলা থাকলে ১৫ জুলাইয়ের পরে ভর্তির প্রক্রিয়া চালু রাখা যাবে, এবং সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে বলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে পরিষ্কার বলা রয়েছে। সেই মতো আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে হলদিয়া মেডিক্যালে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। “কোনও কারণে কোনও ছাত্রছাত্রীর স্বার্থ বিঘ্নিত হলে হাইকোর্ট নীরব থাকতে পারে না।” রায়ে বলেছে বেঞ্চ।
এ প্রসঙ্গেই পুরো বিষয়টিতে রাজ্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের ভূমিকার দিকে হাইকোর্ট আঙুল তুলেছে। ডিভিশন বেঞ্চের মতে, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই হলদিয়া মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করার পিছনে রাজ্য সরকার ও এমসিআইয়ের পেশ করা যুক্তিগুলোতেও সারবত্তা দেখতে পায়নি ডিভিশন বেঞ্চ। বিশেষত যে ডেন্টাল কলেজ নিয়ে এমসিআইয়ের আপত্তি, সেটি দীর্ঘ দিন আগে অন্য বাড়িতে সরিয়ে নেওয়া হলেও এমসিআই নিজেদের অবস্থান বদলায়নি কেন, সেই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। রায়ে বেঞ্চের মন্তব্য, “একটা চালু কলেজকে কোনও প্রকারে বন্ধ করাই রাজ্য সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল।”
আর এই কারণে রাজ্য সরকার, রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও এমসিআই-কে এ দিন ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছে হাইকোর্ট। সরকারের কী প্রতিক্রিয়া?
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক সূত্রের খবর, ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশের বিরুদ্ধে সরকার সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে। যদিও সরকারি ভাবে তেমন কোনও ইঙ্গিত এখনও মেলেনি। রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য শুধু বলেন, “হাইকোর্টের নির্দেশের প্রতিলিপি হাতে পাইনি। না-পেলে কিছু বলতে পারব না।” হলদিয়া মেডিক্যালের পড়ুয়ারাও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। অনেকের আশঙ্কা, হাইকোর্টের ফয়সালা না-মেনে রাজ্য এ বার সুপ্রিম কোর্টে গেলে তাঁদের ভবিষ্যৎ ঘিরে ফের অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। “এমনিতেই এক বছর পিছিয়ে গিয়েছি। নতুন মামলা হলে ডাক্তারি পড়ার পাটই বোধহয় চোকাতে হবে”, বলেন এক ছাত্রী। কলেজ-কর্তৃপক্ষের কী বক্তব্য?
কর্তৃপক্ষের আশা, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে রাজ্য হয়তো আইনি লড়াই আর দীর্ঘায়িত করবে না। পরিচালকমণ্ডলীর তরফে লক্ষ্মণবাবু এ দিন বলেন, “শুনছি, সরকার সুপ্রিম কোর্টে গেলেও যেতে পারে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়ার মতো আর্থিক সামর্থ আমাদের নেই। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচানোর আবেদন জানাচ্ছি সকলের কাছে।” পড়ুয়াদের স্বার্থে রাজ্যের যে কোনও প্রস্তাব তাঁরা মানতে রাজি বলেও জানিয়েছেন লক্ষ্মণবাবু।” তাঁর কথায়, “রাজ্য সরকার ও স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় লক্ষ্মণ শেঠকে যত খুশি শাস্তি দিক। তবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে পড়ুয়াদের রেহাই দিক। মুখ্যমন্ত্রী ও স্থানীয় সাংসদেরও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত।”
পরিশেষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে সিপিএম নেতার আবেদন, “ওই কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও মুখ্যমন্ত্রী আপনি। তাই ওদের কষ্ট, বেদনা, উদ্বেগের অংশীদার হোন।” |