জন্মদাতারা তাদের ত্যাগ করেছেন। নিতান্ত অবহেলায় শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে পড়েছিল সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত চার ও পাঁচ বছরের দুই শিশু। দু’দিনের তফাতে জিআরপি তাদের উদ্ধার করলেও পুনর্বাসন পেয়ে বাঁচার আশাটুকুই এখন নিভে আসছে তাদের। কারণ, একাধিক হোমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ এখনও পর্যন্ত শিশুদু’টিকে নিতে রাজি হয়নি। প্রত্যেকেই জানিয়েছে, এই ধরনের শিশুর যে বিশেষ দেখভাল ও চিকিৎসার প্রয়োজন, তা তাদের নেই।
আর এই ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, রাজ্যে সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত অনাথ বা গৃহহীন শিশুদের উপযুক্ত হোমের অভাব কতটা। সামনে এনেছে সমাজকল্যাণ দফতরের পরিকল্পনার গলদ। শোরগোল পড়ে গিয়েছে দফতরে।
যাদের নিয়ে এত হইচই, তারা অবশ্য বুঝতে পারছে না কিছুই। আপাতত তাদের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালে। বোবা চাহনি নিয়ে দু’জনেই শয্যায় ঠায় পড়ে। গলা থেকে মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে গোঙানি। |
বছর চারেকের শিশুটিকে গত ২৪ জুলাই শিয়ালদহ স্টেশনে পাওয়া যায়। সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত শিশুটির কোনও বোধ নেই। হাঁটাচলা বা দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। শিশুটিকে সে দিনই কলকাতা শিশু কল্যাণ সমিতির সামনে পেশ করা হয়। তাকে কোনও সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বেসরকারি হোমে রাখার নির্দেশ দেয় সমিতি। কেউ নিতে না চাওয়ায় এখনকার মতো তার ঠাঁই হয়েছে লেক গার্ডেন্সের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাসপাতালে। খরচ দিচ্ছে চাইল্ড লাইন। তারাই শিশুটির নাম দিয়েছে সূর্য। কিন্তু এ-ও জানিয়েছে, এটা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা হতে পারে না।
তা হলে এর পরে শিশুটির কী হবে? সমাজকল্যাণ দফতরের কর্তারা উত্তর দিতে পারেননি।
একই অবস্থা পাঁচ বছরের অন্য শিশুটির। ২৬ জুলাই তাকেও শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কলকাতার শিশু কল্যাণ সমিতি তাকেও কোনও হোমে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। ঠাঁই মেলেনি। সূর্যর সঙ্গে তাই সে-ও আছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ওই হাসপাতালে। নাম দেওয়া হয়েছে আবেশ। হাসপাতালের চিকিৎসক সঞ্চয়ন মালাকার জানান, শিশু দু’টির হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নেই। বরং দরকার বিশেষ প্রশিক্ষণ, বিশেষ পদ্ধতিতে পড়াশোনা ও কাউন্সেলিং, যা হাসপাতালে দেওয়া অসম্ভব।
কেন সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত পরিত্যক্ত শিশুদের হোম মিলছে না? সমাজকল্যাণ দফতরের অধিকর্তা সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এটা আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই ধরনের শিশুদের জন্য হোম প্রায় নেই বললেই চলে। কলকাতা ও তার আশপাশে সাকুল্যে এমন তিনটি হোম আছে। আর জেলায় একটি বর্ধমানে, একটি হাওড়ায় ও একটি হলদিয়ায়। সেখানে আর জায়গা নেই। অন্য হোমগুলি এদের নেয় না। কারণ এদের আলাদা প্রশিক্ষণ দরকার। সরকারের এ নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।”
সমাজকল্যাণ কর্তাদের মতে, সেরিব্রাল পলসি আক্রান্তেরা এমনিতেই পরিবারে আপাংক্তেয়। ফলে এদের ত্যাগ করার, রাস্তায় ফেলে দেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে এদের হোমের প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। মানসিক ভারসাম্যহীন শিশুদের জন্য হোম পেতেও একই অবস্থা হয়। কলকাতা শিশুকল্যাণ সমিতির চেয়ারপার্সন মিনতি অধিকারী অবশ্য বলেছেন, “কিছু একটা করতেই হবে। শিশুদু’টিকে কোনও হোমে পাঠাতে হবে।” কিন্তু জোর করে কোথাও পাঠালে ওই শিশুরা প্রয়োজনীয় বিশেষ প্রশিক্ষণ পাবে কি না, তার জবাব অবশ্য মেলেনি। |