যখন গর্ভসঞ্চার হয়েছিল, তখন মানসিক ভাবে সুস্থ ছিলেন না। তাই প্রসবের পরে সন্তানকে কাছে পাননি বিধির বাধায়। এখন সুস্থ হয়ে উঠলেও সন্তানকে কাছে পাওয়ার অন্তরায় তাঁরই পরিবার।
অগত্যা কলকাতার বহু দূরে, সেই উত্তরবঙ্গের মাটিগাড়ার এক চিলতে ঘরে মিনতি বর্মনের দিন কাটছে ক’দিনের দেখা ছেলের জন্য চোখের জল ফেলে। একরত্তি শিশুটি এখন কোথায়, তা-ও তো জানেন না! বছরখানেক আগে ওঁকে কলকাতার রাস্তা থেকে উদ্ধার করে আদালতের মাধ্যমে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল পুলিশ। ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে জানান, ওই বধূ ‘ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস’-এর শিকার। এ-ও ধরা পড়েছিল, তিনি অন্তঃস্বত্ত্বা। গত মে মাসে ওখানে তিনি পুত্রসন্তান প্রসব করেছিলেন।
|
মিনতি বর্মন |
অবশ্য তার আগেই মিনতি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ডাক্তারেরা তাঁকে ‘সম্পূর্ণ সুস্থ’ বলে ছাড়পত্রও দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাড়ি থেকে কেউ নিতে না-আসায় হাসপাতাল তখনও তাঁকে ছাড়েনি। পাশাপাশি জন্মের দিন কয়েক পরে আলাদা হয়ে যাওয়া দুধের ছেলেকেও ফিরে পাননি। কেন?
হাসপাতাল-সূত্রের খবর: পাভলভের ওয়ার্ডে সদ্যোজাত শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মা-শিশুকে রেফার করা হয়
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে বাচ্চার অবস্থা একটু স্থিতিশীল হওয়ার পরে মিনতিকে পাভলভে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ছেলে থেকে যায় ন্যাশনালের শিশু ওয়ার্ডেই, কারণ মানসিক হাসপাতালে সদ্যোজাতকে রাখার পরিকাঠামো নেই। এ দিকে শিশু ওয়ার্ডের বেড-ই বা কত দিন আটকে রাখা যাবে? ন্যাশনালের তরফে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা মিনতির সন্তানকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে হোমে পাঠিয়ে দেয়।
মিনতি এতশত জানতেন না। তিনি পাভলভে ফিরে বাচ্চার জন্য কান্নাকাটি শুরু করায় সেখানে কর্মরত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ন্যাশনালে গিয়ে তাঁর ছেলের খোঁজ করে। তখনই ধরা পড়ে, বাচ্চার ঠিকানা বদলে গিয়েছে! মায়ের অনুমতি না-নিয়েই ছেলেকে হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হল?
পাভলভের সুপার রাঘবেশ মজুমদার বলছেন, “এটাই দস্তুর। মা মানসিক রোগী হয়ে হাসপাতালে থাকলে তাঁর কাছে সন্তানকে দেওয়া যায় না।” একই কথা বলেছেন চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি-র চেয়ারপার্সন মিনতি অধিকারী। “আমাদের এখানে মানসিক হাসপাতাল থেকে এমন অনেক বাচ্চা আসে। তাদের বিভিন্ন হোমে রাখা হয়।” কিন্তু মা যেখানে সুস্থ হিসেবে ডাক্তারের সার্টিফিকেট পাচ্ছেন, তাঁর বাচ্চার ক্ষেত্রে অনুমতি নেওয়া হবে না কেন?
মিনতিদেবীর যুক্তি, “তাতে কী? উনি তো তখনও মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাননি! ওখানে শিশুটির নিরাপত্তা নিয়েও সংশয় থাকে।” তা হলে সুস্থ হয়ে ওঠা মা ও তাঁর সন্তানকে এ ভাবে আলাদা না-করে এক সঙ্গে কোনও হোমে রাখার উদ্যোগ কেন হল না, রাঘবেশবাবু অবশ্য তার সদুত্তর দিতে পারেননি।
আইন বলছে, মানসিক রোগী সুস্থ হয়ে গেলেও বাড়ির কেউ নিতে না-এলে তিনি হাসপাতাল ছাড়তে পারেন না। বস্তুত এই কারণেই বহু মানুষ সুস্থ হয়ে উঠেও বছরের পর বছর মানসিক হাসপাতালে থেকে যেতে বাধ্য হন। মিনতিকেও হয়তো হতো। হয়নি, কারণ তাঁর পরিবারের খোঁজ মিলেছিল। স্বেচ্ছাসেবীরা বধূটির মুখ থেকে জানতে পেরেছিলেন, মাটিগাড়ায় তাঁর স্বামী রয়েছেন, আছে এক কিশোরী কন্যাও। ঠিকানা নিয়ে সোজা মাটিগাড়ায় চলে যান স্বেচ্ছাসেবীরা। জানা যায়, মিনতি আড়াই বছর আগে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাড়িতে চিকিৎসা চলছিল। বছর দেড়েক আগে আচমকা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরে হাসপাতাল থেকে খবর পেয়েও ঘরের বৌকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবেননি বাড়ির লোক।
স্বেচ্ছাসেবীরা অনেক বোঝানোয় মিনতির স্বামী দয়াল বর্মন কলকাতায় এসে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হন। কাঠের দোকানের কর্মী দয়ালবাবু যদিও সাফ জানিয়ে দেন, যে হেতু তাঁর স্ত্রী গর্ভবতী হয়েছেন বাড়ি ছাড়ার পরে, কাজেই ওই ছেলে কোনও ভাবেই তাঁর নয়। তাই ছেলের দায়িত্ব তিনি নেবেন না। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির তরফে অদিতি বসু বলেন, “আমরা বোঝানোর বহু চেষ্টা করেছিলাম। ওঁকে নড়ানো যায়নি।” মিনতিও মনে করতে পারেননি, কী ভাবে তিনি গর্ভবতী হলেন। সমাজকর্মীদের অনুমান, নিরাশ্রয় এক মানসিক রোগিণী পথে-ঘাটে যে ধরনের অত্যাচারের শিকার হতে পারেন, মিনতির উপরেও তেমন কিছু ঘটেছিল। কিন্তু যে হেতু তিনি জন্ম দিয়েছেন সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায়, তাই সন্তানকে ভুলে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব বলে মনে করছেন মনোবিদেরা।
আপাতত সেই ‘না-ভোলার’ জের টেনে চলেছেন মধ্য ত্রিশের গৃহবধূ। বহু ঝড়ঝাপটা সয়ে ঘরে ফিরলেও কার্যত ঘরবন্দি হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পেটের ছেলেকে পেতে হলে তাঁকে মাতৃত্বের অধিকার প্রমাণ করতে হবে। সে সব রেকর্ড কোথায়, কী ভাবে মিলবে, তিনি জানেন না। তবে এটুকু বিলক্ষণ জানেন, এ নিয়ে এক পা এগোতে গেলেও বাড়ি ছাড়তে হবে। স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেননি দয়ালবাবু। “আমি চাই না, মাঝের ওই দেড় বছরের কোনও কিছু ও মনে রাখুক।” ফোনে বলেছেন স্বামী। আর ফোনে ধরা হলে কান্নায় ভেঙে পড়ে মিনতি বলেছেন, “জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কচি মুখটা আমি ভুলতে পারব না।”
মানবাধিকার কর্মী রত্নাবলী রায়ের আক্ষেপ, “এখানকার সমাজে যে মানসিক রোগীদের নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে না, এই ঘটনা তা ফের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। সুস্থ হয়েও মা নিজের সন্তানকে কাছে পাচ্ছেন না! এ তো আমাদের সকলের লজ্জা।” |