মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাহাড় সফর কার্যত ‘বয়কট’ করারই ডাক দিল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। মুখ্যমন্ত্রী ২ এবং ৩ সেপ্টেম্বর পাহাড়ে যাচ্ছেন। সেই দু’দিনই নেপালি ভাষায় ‘ঘর ভিতরো জনতা’ অর্থাৎ ‘ঘরে বসে থাকবে জনতা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে মোর্চার নেতৃত্বাধীন গোর্খাল্যান্ড জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি। মুখ্যমন্ত্রীর সফরের ঠিক আগে শনিবার এক দিনের
জন্য বন্ধ শিথিল করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে তারা।
মোর্চার সহকারী সাধারণ সম্পাদক জ্যোতিকুমার রাই অবশ্য দাবি করেছেন, “আমরা বয়কটের কথা বলিনি। আমরা আমাদের কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। তৃণমূল যে সামান্য কিছু লোকজন পাহাড়ে জোগাড় করেছে, তাঁরা কী করবেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার।” তবে মুখ্যমন্ত্রীর পাহাড় সফরের সময় মোর্চার এই কর্মসূচিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কথায়, “পাহাড়ের মানুষ বন্ধের বিপক্ষে। তাঁরা শান্তি ও উন্নয়নের পক্ষে।”
তৃণমূল ও রাজ্য সরকার মনে করছে, মোর্চার নানা উন্নয়ন বিরোধী কাজকর্ম কিংবা ‘ফতোয়া’ নীরবে সব পাহাড়বাসী মেনে নেবেন, এমন দিন এখন আর নেই। ঘটনাচক্রে, এদিনই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব দার্জিলিঙের গরুবাথান, গৈরিবাস, রঙ্গো, ঝালংয়ে দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত ঘুরে চাল-ডাল-আলু-আটা বিলি করেছেন। সে সব জায়গায় লাইন দিয়ে সব মিলিয়ে অন্তত ১ হাজার জন পাহাড়বাসী রসদ নিয়েছেন। গৌতমবাবু বলেন, “মানুষের ভয় কাটছে। পাহাড়ের মানুষও যথেচ্ছ ফতোয়া অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিকতা দেখে পাহাড়বাসীও ভয় উপেক্ষা করে
রাস্তায় বেরোচ্ছেন। কাজেই মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠান হবেই। পাহাড়বাসী তাতে সামিল হবেন।”
পাহাড়বাসীদের একাংশ যে বন্ধ, ‘ঘর ভিতরো জনতা’ অগ্রাহ্য করে রাস্তায় বার হচ্ছেন, সেটা মোর্চা নেতারাও অস্বীকার করতে পারছেন না। কারণ, কালিম্পং থেকে তিস্তা বাজার, লপচু পেশক হয়ে জোড়বাংলোর রাস্তার প্রায় অধিকাংশ দোকানই কদিন থেকে অর্ধেক ঝাঁপ খুলে ব্যবসা করছে। কালিম্পঙে থানার উল্টো দিকে লেপচা সম্প্রদায়ের ‘শান্তির দাবি’ নিয়ে ধর্নায় ভিড় রোজই বাড়ছে। ঘরে-ঘরে রসদ আনাজের সঙ্কট দেখা দেওয়ায় মোর্চা নেতাদেরও রোজ ট্রাক নিয়ে তা বিলি করতে হচ্ছে। এদিনই দার্জিলিং সদর এলাকায় মোর্চার দেওয়া রসদ নিতে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়েছে। রাজ্য সরকারের খাদ্য সরবরাহ দফতর ১১টি বিশেষ রেশন দোকান খুলেছিল। কিন্তু খাদ্য দফতর জানতে পেরেছে তার মধ্যে ৫টি দোকান থেকে কেউ খাদ্য শস্য কিনতে আসেনি। তবে ৬টি দোকান থেকে প্রায় চার হাজার মানুষ স্বাভাবিক রেশন তুলেছেন। শুক্রবার খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওই তথ্য জানিয়ে বলেন, “সরকারের সিদ্ধান্ত, যত দিন মোর্চার আন্দোলন চলবে তত দিনই ওই ১১টি বিশেষ রেশন দোকান চালু রাখা হবে।” মোর্চা নেতা জ্যোতিকুমার বলেন, “গরিব পাহাড়বাসীর জন্য আমরা রসদ বিলি করছি। সেখানেই প্রকৃত ভিড় হচ্ছে। গৌতমবাবুরা যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে সদ্য তৃণমূলে যোগদানকারীরা রসদ নিচ্ছেন।” পাশাপাশি, তাঁরা পাহাড়বাসীকে কোনও ভয় দেখান না বলে মোর্চার সহকারী সম্পাদক দাবি করেছেন।
মোর্চার অন্দরের খবর, মাস পয়লার কথা ভেবে বেশ কয়েক দিনের জন্যই বন্ধ শিথিল করার দাবি উঠেছিল জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির এ দিনের বৈঠকে। কিন্তু কট্টরপন্থী কিছু নেতা তার প্রতিবাদ করেন। মোর্চা প্রধান বিমল গুরুঙ্গ ও তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বেশ কিছু দিনের জন্য বন্ধ তুলে নিলে মুখ্যমন্ত্রীর কালিম্পঙে লেপচাদের কাছ থেকে সংবর্ধনা নেওয়ার অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে হয়ে যাবে। তখনই বৈঠকে উপস্থিত গুরুঙ্গ ঘনিষ্ঠ এক নেতা মত দেন, বন্ধ যদি তুলতেই হয় তা হলে তা তোলা যাবে মুখ্যমন্ত্রীর সফরের পরে।
মোর্চার মদতে ফের রাজ্যের বিরুদ্ধে পাহাড়ে বিভাজনের রাজনীতির অভিযোগ এনে রবিবার থেকে দার্জিলিঙে লেপচাদের একটি সংগঠন অনশনেও বসছে। কেন্দ্রের উপরে চাপ বাড়াতে পাহাড়ের সব বর্তমান ও প্রাক্তন সাংসদ, বিধায়কদের প্রতিনিধি দলকে দিল্লিতে পাঠানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিটি। ১ সেপ্টেম্বর প্রতিনিধি দল দিল্লি গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইবে।
তবে পাহাড়ের স্কুল-কলেজ খোলা রাখার বিষয়টি খতিয়ে দেখার আর্জি উঠছে বারবার। মোর্চার তরফে জানানো হয়েছে, আগামীকাল, রবিবার দার্জিলিঙের নর্থ পয়েন্ট স্কুলের মাঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক হবে। স্কুল-কলেজ কবে থেকে খোলা রাখা হতে পারে, সেখানে সেই ব্যাপারে আলোচনা হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর পাহাড় সফরের পরেই ৪ সেপ্টেম্বর জিটিএ-র নতুন ‘চিফ এক্সিকিউটিভ’ নিয়োগের বৈঠক। সেখানে কি মোর্চা নেতারা যাবেন? মোর্চার প্রচার সচিব তথা কালিম্পঙের বিধায়ক হরকাবাহাদুর ছেত্রী বলেন, “এটা নিয়ে ভাবার সময়
এখনও আছে। যথাসময়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।”
তবে আন্দোলন বন্ধ করে জনজীবন স্বাভাবিক করার জন্য সব মহল থেকেই চাপ বাড়ছে মোর্চার উপরে। এ দিন শিলিগুড়িতে সিআইআইয়ের একটি সভায় হর্ষ নেওটিয়াও আশা প্রকাশ করেন, পাহাড়ে জনজীবন স্বাভাবিক করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলি উদ্যোগী হবে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও এ দিন বলেন, “আন্দোলনকারীদের আবার বলব, জনজীবন রুদ্ধকারী আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসুন।” কংগ্রেসের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর পাহাড়ে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। মোর্চার কাছে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “বন্ধ অনেক হয়েছে। পাহাড়ের মানুষকে এ বার স্বস্তি দিন।”
|