রাঘব বোয়াল না হয় জালে পড়েছে। কিন্তু তার কিছু সাঙ্গোপাঙ্গ পশ্চিমবঙ্গেই গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে বলে সন্দেহ। রাজ্যের পুলিশ তাই স্বস্তিতে নেই।
ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের ‘অপারেশনাল চিফ’ ইয়াসিন ভটকল নেপাল-বিহার সীমান্তে ধরা পড়ার পরে এ রাজ্যে তার সহযোগীদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করাটাই আপাতত কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর অন্যতম লক্ষ্য। গোয়েন্দারা মনে করছেন, শুধু উত্তর ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ বা নদিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা নয়, খাস কলকাতা ও আশপাশেও ইয়াসিনের শাগরেদরা সক্রিয়। আর এ প্রসঙ্গেই উঠে আসছে ভটকলের অন্যতম প্রধান সহযোগী জইদের নাম। কে সে?
এসটিএফের দাবি: ইয়াসিন ভটকলের যে জঙ্গি ‘নেটওয়ার্ক’ বাংলাদেশ-নেপাল-পশ্চিমবঙ্গকে এক সূত্রে গাঁথছে, তা মূলত জইদ-ই চালায়। লালবাজারের ইঙ্গিত, জইদ এই মুহূর্তে ঢাকার কাছে ঘাঁটি গেড়ে থাকলেও হাতিয়ার, বিস্ফোরক ও জাল নোট সংক্রান্ত ‘কারবারের’ কাজে নিয়মিত নেপাল-বিহার-পশ্চিমবঙ্গে যাতায়াত করে। নদিয়ার সীমান্ত থেকে তার ছবিও এসটিএফের হাতে এসেছে। এবং কেন্দ্রীয় আইবি, এনআইএ ও অন্যান্য রাজ্যের পুলিশকে তা দেখানোর পরে তদন্তকারীদের ধারণা, জইদ কখনও ভারতের মাটিতে ধরা পড়েনি। তা হলে ওর নাম জানা গেল কী ভাবে?
এসটিএফ-সূত্রের খবর: গত ৬ জুলাই কলকাতার অফিসপাড়ায়, অর্থাৎ বিবাদী বাগ চত্বরে বিস্ফোরক ও জাল নোট-সহ জালে পড়ে নদিয়ার চাপড়ার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন মল্লিক। গোয়েন্দাদের অভিযোগ, আনোয়ার ইয়াসিনের ক্যুরিয়র। ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে কলকাতায় এসে তার কাছ থেকেই আট কেজি আরডিএক্স নিয়ে গিয়েছিল ইয়াসিন, যা কয়েক মাস পরে (২০১০-এর ফেব্রুয়ারি) পুণের জার্মান বেকারি বিস্ফোরণে কাজে লাগানো হয় বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এসটিএফ-সূত্রের দাবি: জেরায় আনোয়ার জানিয়েছে, সে বিস্ফোরক পাচার করে এনেছিল বাংলাদেশ থেকে। নদিয়ার গোংরা সীমান্তের ও-পারে, বাংলাদেশের চুয়াডাঙা জেলার কুতুবপুর-মুন্সিপুর গ্রামের কাছে তার হাতে ওই বিস্ফোরকের চালান তুলে দিয়েছিল জইদ।
আনোয়ারের মুখে এ তথ্য জেনে জইদের খোঁজে নেমেছে এসটিএফ। যদিও সে ঠিক কোথাকার লোক, তা নিয়ে ধন্ধ কাটেনি। বস্তুত বাঙালি তো নয়-ই, জইদ আদৌ ভারতীয় কি না, সে ব্যাপারেও গোয়েন্দারা সন্দিহান। “আনোয়ার জানিয়েছে, জইদ হিন্দি-উর্দু মিশিয়ে কথা বলে। তা ছাড়া জইদ ওর আসল নামও নয়, আনোয়ার তাকে জইদ নামে জানে। যেমন সে ইয়াসিন ভটকলকে চিনত ইউসুফ হিসেবে।” বলছেন এক গোয়েন্দা-কর্তা। গোয়েন্দাদের একাংশের মতে, জইদের আসল নাম মনসুর।
এবং জইদ ওরফে মনসুরকে নিয়ে এই মুহূর্তে মাথাব্যথার যথেষ্ট কারণ রয়েছে পুলিশের। এসটিএফের এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “আনোয়ার ধরা পড়লেও জইদ চুপচাপ বসে নেই। আমরা জেনেছি, কলকাতা ও আশপাশে ঘাঁটি গাড়া কিছু মুজাহিদিন-লিঙ্কম্যানের সঙ্গে ও বাংলাদেশ থেকে টেলিফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।” গোয়েন্দা-সূত্রের দাবি, শুধু নদিয়া সীমান্ত দিয়েই অন্তত তিন জন ক্যুরিয়র মারফত জইদ ভারতে বিস্ফোরক ও জাল নোট পাচার করছে। “আইএমের জন্য বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে বিস্ফোরক পাচার-চক্রের মাথা হল জইদ। ভারতের বিভিন্ন শহরে নাশকতা ও জাল নোট ছড়ানোয় ওর ভূমিকা কোনও অংশে কম নয়। তাই ইয়াসিনকে জইদ সম্পর্কে অবিলম্বে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।” মন্তব্য এক তদন্তকারীর।
এ দিকে শুক্রবার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আনোয়ারকে হাজির করানো হলে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বরূপ শেঠ তাকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এসটিএফ জানিয়েছে, একই মামলায় ইয়াসিন ভটকল অন্যতম অভিযুক্ত। আনোয়ার ইতিমধ্যে বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দিতে ইয়াসিনকে বিস্ফোরক হস্তান্তরের কথা কবুল করেছে। এই মামলায় আরও দু’জনের গোপন জবানবন্দি চাইছেন গোয়েন্দাদের একাংশ। তারা কারা?
এক জন হলেন হুমায়ুন, বিস্ফোরক নিতে কলকাতায় এসে বৌবাজারে যার বাড়িতে ইয়াসিন এক রাত কাটিয়েছিল বলে গোয়েন্দাদের দাবি। অন্য জন হলেন তিলজলার ভিআইপিনগরের বাসিন্দা এক
নার্স, যিনি আদতে আনোয়ারের গ্রামের মেয়ে। তদন্তকারীদের দাবি, তাঁর তিলজলার বাড়িতে আনোয়ার শুধু যে বিস্ফোরকের প্যাকেট এনে রেখেছিল তা নয়, ইয়াসিন নিজেও সেখানে গিয়েছিল।
|