এক বার নয়। পর পর দু’বার আউট হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল বাঘা ব্যাটসম্যান। প্রথম বার লোপ্পা ক্যাচ, দ্বিতীয় বার রান আউট করার সুযোগ। দু’-দুবারই মওকা ফস্কেছে কলকাতা পুলিশ। শেষমেশ তাকে ক্রিজ থেকে তুলল কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ।
ব্যাটসম্যানের নাম মহম্মদ আহমেদ জারার সিদ্ধিবাপ্পা ওরফে ইয়াসিন ভাটকল। জঙ্গি সংগঠন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর ‘অপারেশন চিফ’। দু’বার প্রাণ ফিরে পাওয়ার পরে ঝোড়ো গতিতে চার-ছয় হাঁকিয়ে যে কি না রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা-ব্যবস্থার দিকে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। অবশেষে সে জালে পড়ায় দেশের অন্যান্য শহরের মতো কলকাতার নিরাপত্তা-কর্তারাও হাঁফ ছেড়েছেন। শুধু তা-ই নয়, কলকাতা পুলিশের কাছে ভাটকলের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সেই মামলায় তাকে জেরা করতে চায় কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)। এ জন্য ভাটকলকে হেফাজতে পেতে তারা কোর্টে আবেদন করবে।
প্রায় মুঠোয় আসা জঙ্গি-চাঁই কী ভাবে হাতছাড়া হয়েছিল?
লালবাজারের খবর: কেন্দ্রীয় আইবি-র বার্তার ভিত্তিতে ২০০৯-এর নভেম্বরে কলুটোলা স্ট্রিটের ডেরায় এক ব্যক্তিকে পাকড়াও করেছিল এসটিএফ। কলকাতার গোয়েন্দারা তখন তার প্রকৃত পরিচয় ধরতে পারেননি। এসটিএফ শুধু জানত, ধৃতের নাম মহম্মদ আসরফ, এবং সে জাল নোটের কারবারি। মামুলি অপরাধী ঠাউরে গ্রেফতার করা লোকটির সাজাও হয় মামুলি। সে যাত্রা কলকাতায় মাস দেড়েক জেল খেটে সে জামিনে খালাস পেয়ে যায়।
আসরফই যে ভাটকল, তা বোঝা গেল কী করে?
এসটিএফ-সূত্রে বলা হচ্ছে, ক’মাস বাদে পুণের জার্মান বেকারি বিস্ফোরণের তদন্ত-সূত্রে ভুলটা ধরা পড়ে। ২০১০-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় জার্মান বেকারির ওই নাশকতায় চার বিদেশি-সহ ১৭ জন মারা যান, জখম হন অন্তত ৬০ জন। তদন্তে নেমে মহারাষ্ট্র পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াড (এটিএস) একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছিল। তাতে স্পষ্ট দেখা যায়, ইয়াসিন ভাটকল ওখানে বিস্ফোরক বসাচ্ছে। সেই ছবি দেখেই কলকাতার পুলিশ বুঝতে পারে, আসরফ আসলে কে। “তখন অবশ্য হাত কামড়ানো ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না।” মন্তব্য লালবাজারের এক কর্তার।
পরের সুযোগটা কলকাতা পুলিশ পায় পরের বছরেই। ২০১০-এর জানুয়ারির এক বিকেলে। খবর ছিল, ধর্মতলা মোড়ে হাতিয়ারের চালান নিতে আসবে ‘সোনু’ নামে এক অস্ত্র কারবারি, যে আইএমের দ্বারভাঙা গোষ্ঠী (দ্বারভাঙা মডিউল)-র সদস্য। সেই মতো ধর্মতলা মোড়ে এসটিএফ জাল বিছায়। কিন্তু সোনু যে আদতে আইএমের মাথা ইয়াসিন ভাটকল ছাড়া আর কেউ নয়, এসটিএফের কাছে তখন সে খবর ছিল না। সোনুকেও অবশ্য শেষ পর্যন্ত জালে ফেলা যায়নি। কোনও ভাবে বিপদের আঁচ পেয়ে সে সে দিন ধর্মতলা চত্বর মাড়ায়ইনি। গোয়েন্দাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওত পেতে থাকাই সার হয়। প্রায় দু’বছর বাদে দ্বারভাঙা মডিউলের অন্যতম পান্ডা কাতিল আহমেদ সিদ্দিকিকে কলকাতা পুলিশ হাতে পায়। তাকে জেরা করতে গিয়ে এসটিএফ জানতে পারে, আসলে কার নাগাল তারা সে বারও ফস্কেছে!
কলকাতা পুলিশের দাবি, আইএমের দেশজোড়া নাশকতা চক্রান্তে কলকাতা-যোগের অন্যতম
মুখ্য কারিগরও ছিল এই ভাটকল। কী রকম? লালবাজার-সূত্রের খবর: গত ৬ জুলাই কলকাতার অফিসপাড়ায়, অর্থাৎ ডালহৌসি চত্বরে বিস্ফোরক ও লাখ দেড়েক টাকার জাল নোট সমেত ধরা পড়েছে আনোয়ার হেসেন মল্লিক নামে এক ব্যক্তি। এসটিএফের বক্তব্য: নদিয়া জেলার চাপড়ার রানাবন্ধের বাসিন্দা আনোয়ার ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সদস্য, বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে নদিয়া সীমান্ত পেরিয়ে আনা বিস্ফোরক-হাতিয়ারের চালান হস্তান্তরের মূল দায়িত্ব ছিল তার উপরে। গোয়েন্দাদের দাবি: জেরায় আনোয়ার জানিয়েছে, ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে কলকাতার বুকে এমন একটা চালান সে তুলে দিয়েছিল খোদ ভাটকলের হাতে। সায়েন্স সিটির সামনে এক চায়ের দোকানে তা হাতবদল হয়। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “আনোয়ার আমাদের কাছে স্বীকার করেছে যে, ইয়াসিন ভাটকল কলকাতায় এসে তার কাছ থেকে বিস্ফোরক নিয়ে গিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটকে গোপন জবানবন্দিতেও সে তা জানিয়েছে। আনোয়ারের বিরুদ্ধে আমাদের রুজু করা মামলায় ভাটকলও অভিযুক্ত। তাই আমরা তাকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করতে চাইছি।”প্রসঙ্গত, সায়েন্স সিটির ওই মোলাকাতের দু’মাস বাদেই আসরফ নামধারী ভাটকল এসটিএফের হাতের মুঠোয় এসেছিল। তখন তার স্বরূপ ধরতে না-পারলেও গোয়েন্দাদের এখন সন্দেহ, আনোয়ারের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া সেই বিস্ফোরকই জার্মান বেকারিতে কাজে লাগায় ভাটকল। এবং তার পরেও সে একাধিক বার কলকাতায় এসে বিস্ফোরক নিয়ে গিয়ে একাধিক নাশকতায় তা ব্যবহার করেছে বলে লালবাজারের সন্দেহ। এক অফিসারের কথায়, “আমরা মনে করছি, ২০১১-র ১৩ জুলাই মুম্বইয়ের ধারাবাহিক বিস্ফোরণে (১৩/৭) কিংবা এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি হায়দরাবাদের জোড়া বিস্ফোরণে যে বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো ইয়াসিনই কলকাতায় এসে আনোয়ারের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল।” উত্তর চব্বিশ পরগনা ও নদিয়া ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের আর কোন সীমান্ত দিয়ে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন অস্ত্র বা বিস্ফোরক পাচার করছে, ভাটকলের মুখ থেকে সেটা জানাও এসটিএফের বড় উদ্দেশ্য।
তবে লালবাজার একাধিক বার ভাটকলের নাগাল ফস্কালেও শেষমেশ তাকে জালে ফেলার পিছনে পরোক্ষে কলকাতা পুলিশেরই অবদান দেখছে কেন্দ্রীয় আইবি-র একাংশ। এক আইবি-কর্তার ব্যাখ্যা, “ইয়াসিনের হাতে গড়া দ্বারভাঙা মডিউলের মাধ্যমেই তার নাগাল মিলেছে। আর এই দ্বারভাঙা মডিউলের নাগাল পেতে সাহায্য করেছিল কলকাতা পুলিশের এসটিএফ।” কী ভাবে?
আইবি-র খবর: ২০১১-য় এসটিএফ কিছু পুরনো ফোন কল রেকর্ড বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দ্বারভাঙা মডিউলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কাতিল আহমেদ সিদ্দিকির সন্ধান পায়। তার দেওয়া তথ্যের সূত্রে আস্তে আস্তে দ্বারভাঙা মডিউলের লোকজন ধরা পড়তে শুরু করে। গত বছর অক্টোবরে গোষ্ঠীটির আর এক চাঁই ফাসি মেহমুদকে সৌদি আরবে গ্রেফতার করে ভারতে আনা হয়েছে। কাতিলের কাছেই আসাদুল্লা ওরফে হাদ্দি এবং ইয়াসিন-ঘনিষ্ঠ তহসিন আখতারের নাম পাওয়া যায়। তাদের খোঁজ করতে গিয়েই মিলেছে ভাটকলের হদিস। এসটিএফ-সূত্রের দাবি, আসরফের ছবি-সই-আঙুলের ছাপ কলকাতা পুলিশ সংগ্রহ করে রেখেছিল। সেগুলো পরে এনআইএ-কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
২০১০-এ মহারাষ্ট্র এটিসের ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়া ভাটকলের ছবির সঙ্গে আসরফের ছবি যেমন মিলে গিয়েছে, তেমন এ বার ভাটকলকে পাকড়াও করার পরে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে এনআইএ-র বড় সহায় হয়েছে লালবাজারের পাঠানো সেই আঙুলের ছাপ। ভাটকলের সঙ্গে আসাদুল্লাও জালে পড়েছে। তহসিন অবশ্য বেপাত্তা।
|