|
|
|
|
টুন্ডার পর এ বার ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন পাণ্ডা |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি
স্বপন সরকার • পটনা |
জঙ্গি দমনে দ্বিতীয় বড় সাফল্য এল মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যেই। ভারতের মাটিতে সন্ত্রাস চালানোর আরও এক পাণ্ডা ধরা পড়ে গেল গোয়েন্দা জালে।
একটানা সাত বছর ধরে একের পর এক নাশকতার অন্যতম মাথা এবং ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের প্রথম সারির নেতা ইয়াসিন ভাটকলকে বুধবার ভারত-নেপাল সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার সঙ্গেই ধরা পড়ে আরও এক মুজাহিদিন জঙ্গি আসাদুল্লাহ আখতার ওরফে হাড্ডি। ভাটকলের গ্রেফতারকে সাম্প্রতিক কালে গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সবথেকে বড় সাফল্য হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এমনকী গোয়েন্দাদের একাংশ এমনও বলছেন, দু’সপ্তাহ আগে আবদুল করিম টুন্ডাকে ধরার থেকেও বড় সাফল্য ইয়াসিন ভাটকলকে পাকড়াও করা। সেই সঙ্গে তাঁরা এটা বলতেও ছাড়ছেন না, পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর সাধের ‘করাচি প্রোজেক্ট’ বড় ধাক্কা খেল এই গ্রেফতারে।
কী এই ‘করাচি প্রোজেক্ট’?
নয়াদিল্লি যাতে বারবার আঙুল তুলতে না পারে, সে জন্য কাঁটাতার পার করে জঙ্গি না পাঠিয়ে ভারতীয় যুবকদেরই একাংশকে বেছে নিয়ে তাদের মগজ ধোলাই করে তাদের দিয়েই ভারতের মাটিতে নাশকতা চালানোর অঙ্ক কষেছিল আইএসআই। প্রায় এক দশক ধরে একের পর এক ঘটনায় আইএসআই-এর সেই অঙ্ক মোটের উপর সফলই ছিল। যে অঙ্কের ছক মেনে এক সময় তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। |
 |
মোতিহারির আদালতে তোলা হচ্ছে জঙ্গি ইয়াসিন ভাটকলকে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। ছবি: পিটিআই |
কর্নাটকের ভাটকল শহরের দুই ভাই, রিয়াজ ও ইকবালের পাশাপাশি ইয়াসিন ভাটকল, গোরা ইসমাইল, সুলতানের মতো কয়েক জনের হাত ধরে গড়ে ওঠে এই জঙ্গি সংগঠনটি। আর গড়ে ওঠার পর থেকে মুম্বই, বারাণসী, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, পুণে, হায়দরাবাদ-সহ একের পর এক জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কয়েকশো লোকের মৃত্যু ঘটিয়েছে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। সেই সংগঠনের অন্যতম পাণ্ডা ইয়াসিন ভাটকলকে গ্রেফতারের ফলে ভূমিপুত্রদের দিয়ে ভারতে সন্ত্রাস চালানোর আইএসআই-লস্করের পরিকল্পনা বড় হোঁচট খাবে বলেই মনে করছেন গোয়েন্দারা। পাকিস্তান থেকে কী ভাবে, কোন পথে অর্থ, অস্ত্র এবং বিস্ফোরক দিয়ে সন্ত্রাসে মদত দেওয়া হয়, ইয়াসিন মুখ খুললে তা জানা যাবে। পাশাপাশি ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের জাল দেশের কোথায়, কী ভাবে ছড়ানো রয়েছে, তারও হদিস মিলবে বলে আশা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের।
দিন কয়েক আগে প্রায় একই ভাবে ভারত-নেপাল সীমান্ত থেকে ধরা পড়েছিল লস্কর-ই-তইবার অন্যতম সদস্য সৈয়দ আব্দুল করিম ওরফে টুন্ডা। সে দাউদ ইব্রাহিম এবং লস্কর-প্রধান হাফিজ সঈদেরও ঘনিষ্ঠ ছিল। এর আগে আর এক লস্কর জঙ্গি আবু জুন্দালও পুলিশের জালে পড়ে। |
 |
ইয়াসিনের গ্রেফতারকে নিজেদের সাফল্য বলেই দাবি করেছে মনমোহন সরকার। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ বলেন, “এই সরকার সন্ত্রাসবাদ বরদাস্ত করে না। সমস্ত সন্ত্রাসবাদীদের পাকড়াও না করা পর্যন্ত আমরা থামব না। এই বিষয়ে কড়া বার্তা দিতে আমরা দায়বদ্ধ।” নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি নেতৃত্ব বারবার ইউপিএ-সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বা পাকিস্তানের প্রশ্নে নরম মনোভাবের অভিযোগ তুলেছেন। কংগ্রেসের একটা বড় অংশ মনে করে, আবু জুন্দাল বা টুন্ডাকে তাদের আমলে ধরা হলে বিজেপি যে ভাবে ঢাক পেটাত, কংগ্রেস বা ইউপিএ সরকার তা করতে পারেনি। বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ বলেন, “আমরা ভাটকলের গ্রেফতার নিয়ে খুব বেশি বড়াই করতে চাই না। এখনও ভারতের ‘মোস্ট
ওয়ান্টেড’ তালিকায় অনেক নাম রয়েছে। তবে এই গ্রেফতারে আমরা সন্তুষ্ট।” এ দিন ভাটকলকে গ্রেফতারের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাদের দাবি, ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসিন ভাটকল ওরফে মহম্মদ আহমেদ জারার সিদ্দিবাপ্পা শুধু যে নিজে হাতেকলমে বিস্ফোরণ ঘটাতো, তা নয়। সংখ্যালঘু যুবকদের মগজধোলাই করে জেহাদি তৈরি করা এবং তাদের নাশকতার প্রশিক্ষণও দিত ইয়াসিন। লস্করের নির্দেশ মেনেই এই যুবকদের খেপিয়ে তুলতে বাবরি মসজিদ এবং গোধরা প্রসঙ্গ তুলত সে। বিহারের যুবকদের নিয়ে কুখ্যাত ‘দ্বারভাঙা মডিউল’-ও তিরিশ বছর বয়সী ইয়াসিনের নিজের হাতে তৈরি। |
 |
প্রথমে সে যোগ দেয় জঙ্গি-ছাত্র সংগঠন সিমি-তে। সিমি নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ওই দলের সদস্যদের ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনে নিয়ে আসে। ওই যুবকদের নিয়ে নানা জায়গায় সংগঠন তৈরির কাজও করত ইয়াসিন। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, রিয়াজ ও ইকবাল বা আবদুল সুভান কুরেশির মতো মুজাহিদিনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যরা একটা সময়ের পর পাকিস্তান, দুবাই বা শারজায় গিয়ে গা-ঢাকা দেয়। কিন্তু ইয়াসিন কখনওই পাকাপাকি ভাবে ভারত ছাড়েনি। ২০০৭ সালে বারাণসীর আদালতের বিস্ফোরণে প্রথম বার ইয়াসিনের নাম উঠে আসে। ২০০৬ মুম্বইয়ের ট্রেন, ২০০৮-এ জয়পুর, আমদাবাদ, দিল্লির ধারাবাহিক বিস্ফোরণ, ২০১০-এ বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম ও পুণের জার্মান বেকারি বিস্ফোরণ, ২০১১ সালের দিল্লি হাইকোর্ট বিস্ফোরণ, তার পরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে হায়দরাবাদের দিলসুখনগরের বিস্ফোরণ এবং সম্প্রতি বুদ্ধগয়ার বিস্ফোরণেও ইয়াসিন তথা ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে কলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও সে যাত্রায় চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে যায় সে। বিস্ফোরক তৈরিতে দক্ষতার পাশাপাশি ছদ্মবেশ ধরতে বা ভুয়ো পরিচয়ে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে ওস্তাদ ইয়াসিন পুণের জার্মান বেকারিতে নিজের হাতে বিস্ফোরক রেখে গিয়েছিল বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ। কারণ সিসিটিভি-তে ইয়াসিনের মতো চেহারার এক জনেরই ছবি মিলেছিল। কিন্তু ২০১১ সালেও চেন্নাইয়ে পুলিশের হাত গলে বেরিয়ে যায় সে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, হায়দরাবাদের দিলসুখনগরে বিস্ফোরণের পর থেকেই ইয়াসিনের গতিবিধির উপরে নজর রাখছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো। গোয়েন্দাদের কাছে খবর ছিল, ভাটকল প্রায়ই নেপালে যাতায়াত করছে। সরকারি ভাবে আজ সকাল ৮টা নাগাদ পূর্ব চম্পারণের রক্সৌলের নহরচক থেকে ইয়াসিন ও হাড্ডিকে গ্রেফতার করা হয়। গোয়েন্দারা অবশ্য রাত তিনটেতেই তাদের আটক করেছিলেন। তবে প্রথমে গোয়েন্দারা ইয়াসিনের পরিচয় নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। ইয়াসিনও পুলিশ-কর্তাদের বোকা বানানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জেরার মুখে ভেঙে পড়ে সে। গ্রেফতারের পরে তাদের নিয়ে আসা হয় মোতিহারিতে। জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) প্রধান শরদ কুমার এমনিতেই এই সময় বিহারে। এনআইএ-র অফিসারেরাও মোতিহারিতে পৌঁছে যান। এক দফা জেরার পরে ভাটকলদের নিয়ে আসা হয় মেতিহারির পুলিশ লাইনে। সেখানে ডাক্তারি পরীক্ষার পর তাদের পেশ করা হয় মোতিহারির মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। দিল্লিতে আনার পরে ইয়াসিনকে এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হবে। এর পরে বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ বাহিনী তাকে জেরা করবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, আবু জুন্দাল বা টুন্ডার থেকেও ইয়াসিন ভাটকলের গ্রেফতার দেশের নিরাপত্তার দিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ দাউদ ইব্রাহিম ও তার ডি-কোম্পানি নিজেদের সন্ত্রাস-ব্যবসা অনেকটাই গুটিয়ে নিয়ে অন্যত্র মনোনিবেশ করেছে। এই অবস্থায় আইএসআই-লস্করের প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠে ভাটকলদের ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন। রিয়াজ-ইকবাল ও অন্যরা হাফিজ সঈদের নির্দেশ পৌঁছে দিত ভারতে। সেই অনুযায়ী নাশকতার ছক কষত ইয়াসিনরা। এ জন্য উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র ও বিহার থেকে জেহাদি নিয়োগের কাজ করত ইয়াসিন। সেই সন্ত্রাসবাদী তৈরির কারখানা বন্ধ করার কাজ এ বার কিছুটা হলেও সহজ হয়ে যাবে বলেই সরকারের দাবি। |
পুরনো খবর: মুম্বই বিস্ফোরণেও সেই ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন |
এই সংক্রান্ত খবর... |
দু’-দু’বার মুঠোয় পেয়েও ফস্কেছে লালবাজার |
|
|
 |
|
|