চিন্তা হতেই পারে, কিন্তু আতঙ্কের কোনও কারণ নেই টাকার পতন তথা অর্থনীতির সার্বিক সঙ্কট নিয়ে অবশেষে মুখ খুলে আজ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এই ভাবেই আতঙ্ক কাটানোর চেষ্টা করলেন। যুক্তি দিলেন, ভারতীয় অর্থনীতির ভিত যথেষ্ট মজবুতই রয়েছে। মার্কিন মুলুক থেকে ভারতে আসা আর্থিক সংস্থাগুলির লগ্নি আবার নিজের ঠিকানায় ফিরতে শুরু করায় অর্থনীতির আকাশে যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে, তা সামলে নেওয়া যাবে।
এমনিতে শিল্পমহল থেকে লগ্নিকারী, সকলেই চাইছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাঁর অর্থনৈতিক বুদ্ধি দিয়ে বর্তমান সঙ্কটমোচনের দিশা দেখান। শুক্রবার কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, অর্থনীতিবিদ মনমোহন সেই ‘প্রেশক্রিপশন’-ও দিলেন। কিন্তু সেই দাওয়াই মেনে রাজনৈতিক বাধা কাটানোর কোনও উপায় দেখাতে পারলেন না প্রধানমন্ত্রী মনমোহন।
অর্থনীতিবিদ মনমোহন স্পষ্টই বললেন, সহজ সংস্কার শেষ। এ বারে সরকারকে হাত দিতে হবে ভর্তুকি ছাঁটাই, বিমা ও পেনশন ক্ষেত্রে সংস্কার, পণ্য পরিষেবা কর চালুর মতো বিষয়ে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে শিল্পমহলও সেটাই চাইছে। কিন্তু ভোটের যেখানে বেশি দিন বাকি নেই, তখন এই ধরনের কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া কি আদৌ সম্ভব? মনমোহন বিলক্ষণ জানেন, এর কোনওটাই তাঁর বা তাঁর দলের জনপ্রিয়তা বাড়াবে না। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্যের। এ দিন সংসদের বক্তৃতায় সে কথাও বলেছেন তিনি। কিন্তু কী ভাবে ঐকমত্য তৈরি করা যাবে, সেই পথ দেখাতে পারেননি। বরং আজ সংসদে প্রধান বিরোধী দলের যে রণং দেহি মূর্তি দেখা গিয়েছে, তাতে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কতখানি সহায় হবেন, সেটাই এখন প্রশ্ন। তাই দিনের শেষে কোনও দিশা দেখতে পাচ্ছে না শিল্পমহলের একটি বড় অংশ। তারা উল্টে মনে করছে, রাজনীতির ফাঁদে পড়ে আরও এক বার অর্থনীতি পিছনের সারিতে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আর তাতেই তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে হতাশা।
এ দিন কী বলেছেন মনমোহন?
বিস্তারিত দেখতে
ক্লিক করুন... |
 |
আতঙ্ক কাটাতে নেমেও প্রধানমন্ত্রী মেনে নিয়েছেন, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) বৃদ্ধির হার সে ভাবে বাড়বে না। পরে দেখা গিয়েছে যে, সত্যিই তা এক পা-ও উপরে উঠতে পারেনি। বরং গত বছরের তুলনায় নেমে এই হার দাঁড়িয়েছে ৪.৪%-এ। যা গত চার বছরে সর্বনিম্ন। দুশ্চিন্তার আরও কারণ হল, উৎপাদন ১.২ শতাংশ কমেছে। দেশের অর্থনীতিতে যে চাহিদা কমছে, মানুষ খরচে রাশ টানছে, তারও প্রমাণ মিলেছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, শুধু যে বিদেশি লগ্নি ভারত থেকে বিদায় নিচ্ছে, তা নয়। ভারতের লগ্নিকারীরাও অনেক ক্ষেত্রে বিদেশে বিনিয়োগ করতে বেশি নিশ্চিন্ত বোধ করছেন।
এত ‘না’-এর কথা মেনে নিয়েও কিন্তু আশা ছাড়তে রাজি নন মনমোহন। বরং তাঁর আশা, চলতি বছরেই আর্থিক বৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশে ফিরবে। তিনি জানিয়েছেন, ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমলে রফতানির দিক থেকেই লাভ হবে। ফলে বিদেশি মুদ্রা আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কমানোও সম্ভব হবে। তা হলে এ বছর তা সাত হাজার কোটি ডলারেই বেঁধে রাখা যাবে। পরে ধাপে ধাপে তা ২.৫ শতাংশে কমিয়ে আনার কথাও বলেছেন তিনি। আর তাই উড়িয়ে দিয়েছেন ১৯৯১ সালের মতো বিদেশি মুদ্রার সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও।
প্রধানমন্ত্রী উৎপাদন শিল্প এবং তার হাত ধরে কর্মসংস্থানকে চাঙ্গা করার কথা বলছেন ঠিকই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, যত ক্ষণ না বিনিয়োগ আসছে, তত ক্ষণ নতুন কর্মসংস্থান কী ভাবে তৈরি হবে? অর্থনীতির হাঁড়ির হালে যেখানে দেশি শিল্পপতিরাই টাকা ঢালার আগে দশ বার ভাবছেন, সেখানে এই সমস্যা মিটবে কী করে? এই প্রশ্ন তুলেছেন শিল্পপতি হর্ষ গোয়েন্কা। আরপিজি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান বলেন, “বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এখনও হতাশা রয়েছে। বিনিয়োগ না এলে নতুন ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ কর্মসংস্থান কী ভাবে তৈরি হবে, সেটাই প্রশ্ন।” মারিকো সংস্থার প্রধান হর্ষ মারিওয়ালার বক্তব্য, “এখন বড় মাপের সংস্কার দরকার।” বণিকসভা সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “প্রথম তিন মাসের আর্থিক ফলাফল থেকে স্পষ্ট, বিনিয়োগকারীদের মনোভাবের কোনও উন্নতি হয়নি। টাকার পতন, নগদ জোগানে টান, সুদের চড়া হার, লাল ফিতের ফাঁস সব কিছু বিনিয়োগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই দুষ্টচক্র ভাঙতে সঠিক বার্তা দেওয়া প্রয়োজন।”
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য আজ সংসদে যুক্তি দিয়েছেন, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে হাল শোধরাবে। এ জন্য তিনি সব থেকে বেশি ভরসা রাখছেন ভাল বর্ষার উপরে। কৃষিতে উৎপাদন বাড়লে তাতে ভর করেই বৃদ্ধির হার ঘুরে দাঁড়াবে। নতুন ফসল বাজারে এলে কমবে মূল্যবৃদ্ধির হার। সেই সঙ্গে নতুন প্রকল্পে ছাড়পত্র দেওয়া, বিদেশি লগ্নির দরজা আরও খোলা এবং কর ব্যবস্থা নিয়ে লগ্নিকারীদের আশঙ্কা দূর করার যে সব চেষ্টা হয়েছে, তারও ফল মিলতে শুরু করবে। প্রধানমন্ত্রীর এই যুক্তিকে সমর্থন জানিয়েছেন তাঁর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান সি রঙ্গরাজন। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ সমীরণ চক্রবর্তীর মতে, “ভাল বর্ষার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির মন্দা কাটলে রফতানিও বাড়বে। সামনে ভোট আছে। সেই বাবদ যে টাকা খরচ হবে, তা অর্থনীতিতে অর্থের জোগান বাড়াবে। এই তিনটিই আশার কারণ।”
টাকার পতনের কারণ ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আজ মনমোহন যুক্তি দিয়েছেন, আমেরিকার অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে সে দেশে লগ্নি ফিরতে শুরু করায়, শুধু টাকা-ই নয়, ব্রাজিল, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো সব দেশেরই মুদ্রার দাম কমেছে। তবে ভারতের চলতি খাতে লেনদেনের ঘাটতিও বাড়তি সমস্যা। এর কারণ, ভারতকে প্রচুর পরিমাণে সোনা,
পেট্রোপণ্য ও কয়লা আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বাড়ায় এই বাবদ খরচ বেড়েছে। উল্টো দিকে আবার এত দিন পশ্চিমী দুনিয়ায় মন্দার জন্য রফতানির বাজার এমনিতেই ভাল ছিল না। তার উপরে আবার আকরিক লোহা রফতানি করা যায়নি (কয়লা ও লোহার সমস্যার জন্য অবশ্য সরকারের দুর্নীতিকেই দায়ী করছেন বিরোধীরা)। তাতেই বেড়েছে
লেনদেন খাতে ঘাটতি। এর সমাধানে আমদানি কমিয়ে রফতানি বাড়ানোর কথা বলেছেন মনমোহন। কিন্তু কী ভাবে তা সম্ভব, সেই দিশা দেখাতে পারেননি তিনি।
রাজকোষ ঘাটতিও ৪.৮%-য় বেঁধে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মনমোহন। তাঁর আশ্বাস, হিসেব কষে খরচ করতে হবে। গরিবদের জন্য ভর্তুকি যাতে অপচয় না হয়, নজর রাখা হবে। জ্বালানি ও সোনা আমদানির খরচ কমানো হবে। কিন্তু কী ভাবে তা কমবে, তার পথ দেখাননি তিনি। অর্থ মন্ত্রক সূত্র বলছে, ডলারে জ্বালানি আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় পেট্রোপণ্যের দাম বাড়াতে হবে। নয়তো ভর্তুকি বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে রাজকোষ ঘাটতিকে আগের লক্ষ্যমাত্রায় বেঁধে রাখতে গেলে বাজেটের পরিকল্পনা খাতে খরচে কাটছাঁট করতে হবে। কিন্তু ভোটের বছরে জ্বালানির দাম বাড়ানো বা খরচ কমানো কতখানি সম্ভব হবে, প্রশ্ন থাকছেই। সিআইআই সভাপতি এস গোপালাকৃষ্ণন, ফিকি-র সভানেত্রী নয়না লাল কিদোয়াইরা মনে
করছেন, রাজকোষ ঘাটতিকে লাগামে রাখার আশ্বাস সন্তোষজনক। কিন্তু সংস্কারের প্রশ্নে নির্দিষ্ট দিশা মিললে লগ্নিকারীদের আস্থা ফেরাতে সুবিধা হতো। এখানেই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না অর্থনীতিবিদ মনমোহনকে।
|