একই ভুল, বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন পুলিশকর্মী |
নিলয় দাস ও নারায়ণ দে • আলিপুরদুয়ার |
ঝিটকার জঙ্গলে ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে বিস্ফোরক ঠাসা দুধের ক্যানটা খোলার ফাঁকে বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের কর্মীটি বলেছিলেন, “কাছে এসে শিখে নিন কী করে মাইন নিষ্ক্রিয় করতে হয়...।” কথা শেষ হয়নি। তুমুল বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন ওই কর্মী।
সাত বছরেও ঝিটকা থেকে শিক্ষা নেননি পুলিশ কর্মীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে আলিপুরদুয়ারের বিএম ক্লাবের মাঠে তারই খেসারত দিলেন বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের আরও এক কর্মী, লালবাহাদুর লোহার (৪৮)।
তিনি অবশ্য, আশপাশে ভিড় করা জনতাকে বোমা নিষ্ক্রিয় করার পদ্ধতি শেখাতে ডাকেননি। বরং নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে হাত বাড়িয়েছিলেন বিস্ফোরক ঠাসা ক্যানটির দিকে।
তবে সুরক্ষার লেশমাত্র ছিল না তাঁরও। বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার আগে যে সুরক্ষা পোশাক বা ‘বম্ব-স্যুট’ পরা আবশ্যক, তা পরেননি ওই পুলিশ কর্মী। |
|
বিস্ফোরণের ঠিক আগের মুহূর্তে লালবাহাদুর লোহার। বৃহস্পতিবার। |
ঘড়িতে তখন ঠিক ১০টা ১০। বিস্ফোরক ঠাসা ওই দুধের ক্যানটি যে ব্যাগে ছিল তার মধ্যে হাত ঢোকাতেই আচমকা প্রবল বিস্ফোরণ। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছিল গোটা মাঠ। ধোঁয়া থিতিয়ে গেলে দেখা যায় ফুট বিশেক দূরে ছিটকে পড়ে রয়েছেন লালবাহাদুর। তাঁর দু’টি হাতের কব্জিই ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে মুখ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। বিস্ফোরণে জখম হয়েছেন, বম্ব স্কোয়াডের আরও দুই কর্মী-সহ আলিপুরদুয়ার থানার এক কনস্টেবলও। তাঁদের হাতে-পায়ে-বুকে বোমার আঘাত লেগেছে। জখম পুলিশকর্মীদের ভর্তি করা হয়েছে আলিপুরদুয়ার মহকুমা হাসপাতালে।
পুলিশ নিশ্চিত, শহরের প্রাণকেন্দ্র চৌপথি এলাকায় বোমাটি রেখে গিয়েছিল কেএলও সমর্থকেরা। জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি বলেন, “কী ধরনের বিস্ফোরক ছিল তা খতিয়ে দেখতে শুক্রবারই ফরেন্সিক দল আলিপুরদুয়ারে এসে পৌঁছবে। কারা বোমা রেখেছিল সে বিষয়ে পুলিশের কাছে কিছু খবর এসেছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই সব কিছু বলা সম্ভব নয়। ওই বোমা রাখার সন্দেহে ইতিমধ্যেই এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
বাঁকুড়ার বারিকুলেও ঠিক এমনটাই ঘটেছিল ২০০৫ সালে। মাওবাদী হানার তদন্তে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা একটি ব্যাগ তুলে নিয়ে এসেছিলেন বারিকুল থানার ওসি প্রবাল সেনগুপ্ত। তারপর সহকর্মীদের নিষেধ সত্ত্বেও সেই ব্যাগের চেন খুলে হাত ঢোকাতেই ভয়াবহ বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। গত বিধানসভা নির্বাচনের পরে বীরভূমের নানুরেও একই ভাবে অত্যন্ত নির্বিকার ভঙ্গিতে একটি দেশি বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিস্ফোরণের শিকার হয়েছিলেন বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডেরই এক কর্মী। |
|
বিস্ফোরণের ঠিক পরের মুহূর্ত। |
ক্রমান্বয়ে এমন ঘটনার পরেও পুলিশ কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা ফিরছে না কেন? প্রতি বারের মতো এ প্রশ্ন এ দিনও উঠেছে। জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশের এক পদস্থ কর্তাও তাঁর বিস্ময় আড়াল করছেন না, “বম্ব জ্যাকেট পরা বা অন্য কোনওরকম সর্তকতা অবলম্বন না করেই ওই কর্মী কোন ভরসায় বিস্ফোরকের ক্যানটি খুলতে গেলেন তা বুঝতে পারলাম না!”
শিলিগুড়ি থেকে আসা বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের সঙ্গে সুরক্ষা পোশাক বা বম্ব স্যুট ছিল না? ওই বিভাগের এক কর্মী স্পষ্টই তাঁর ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন, “শিলিগুড়ি বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডে একটি মাত্র বম্ব স্যুট রয়েছে বটে, কিন্তু সেটা পরা না-পরা সমান। ওই পুরু এবং ভারী পোশাকটি পড়লে যাতে গরম না লাগে সে জন্য একটি ‘কুলিং লেয়ার’ থাকার কথা। এক বছর ধরে সেটি খারাপ। ফলে ওই বম্ব স্যুট পরলে মিনিট কয়েকের মধ্যেই দমবন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়। কে পরবে!” কাজেই সে সব পোশাকের তোয়াক্কা না করে আলিপুরদুয়ারের ওই মাঠে বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়েছিলেন লালবাহাদুর, ও তার দুই সঙ্গী ফিরোজ আলম ও অসিত মুখোপাধ্যায়। পুলিশ জানায়, বুধবার ভোররাতে শহরের চৌপথি এলাকায় একটি মিষ্টির দোকানের পাশে সাইকেলের হাতলে ঝোলানো ব্যাগ দেখে টহলদারি পুলিশের সন্দেহ হয়েছিল। রাতেই ওই ব্যাগের মধ্যে উদ্ধার হয় প্রায় চার কেজি ওজনের বোমাটি। সকালে বম্ব স্কোয়াডের কর্মীরা আসার পরে স্থানীয় ওই মাঠে বোমাটি রাখা হয়। প্রথমে দড়ি দিয়ে ক্যান সমেত ব্যগটিকে বেঁধে টানাটানি করা হয় কিছুক্ষণ। বোমাটি ফাটেনি। অগত্যা সেটি খুলে দেখতে গিয়ে ছিলেন ওই পুলিশ কর্মী। সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণ ঘটে।
|
—নিজস্ব চিত্র |
|
সেপ্টেম্বর ২০০৬ |
লালগড়ের ঝিটকার জঙ্গলে উপযুক্ত পোশাক ছাড়াই মাইন
নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিস্ফোরণে হত দুই। জখম ১৯। |
এপ্রিল ২০০৮ |
কালনায় উপযুক্ত পোশাক ছাড়া বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে
বম্ব স্কোয়াডেরই এক জনের হাত
উড়ে যায়। |
নভেম্বর ২০১১ |
বীরভূমে নানুরের সুচপুরে গর্তে বোমা রেখে ফাটানোর
সময় মারা যান সাব-ইনস্পেক্টর। |
অগস্ট ২০১৩ |
আলিপুরদুয়ারে খালি হাতে বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে প্রাণ
গেল বম্ব স্কোয়াডের এক কর্মীর। জখম তিন জন। |
|
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
• সে দিন নিয়ম মানা হলে হারাতে হত না চোখটা |
|