|
|
|
|
বনধের এক মাস |
খাবার নেই ঘরে, পাহাড়বাসীর ভরসা থোড়-কচু |
কিশোর সাহা • দার্জিলিং |
বিস্কুট? নেই। তিন দিনের বাসি পাঁউরুটি আছে, খেতে পারেন।
এমনই অভ্যর্থনা মিলল কালিম্পঙের এক অতিথি আবাসে। বৃহস্পতিবার এক মাসে পড়ল পাহাড়ের বনধ। দার্জিলিঙের তিন মহকুমা জুড়ে প্রায় এক টানা বন্ধ রয়েছে দোকান-বাজার, অফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ। ঘরবন্দি দিন কাটছে মানুষের। মাঝে তিন দিনের জন্য বনধ একটু শিথিল হতেই ভিড় জমেছিল ব্যাঙ্কে, বাজারে। কিন্তু তারপর আবার ফুরিয়েছে খাবার, হাতে নেই টাকাও। বৃহস্পতিবার পাহাড়ে গিয়ে দেখা গেল, আশেপাশের কলা গাছ থেকে মোচা- থোড় কেটে, বুনো মানকচু তুলে এনে পেট চালাচ্ছেন পাহাড়ের মানুষ।
রান্নার গ্যাসও ব্যবহার করতে হচ্ছে সাবধানে। সিলিন্ডার ফুরলে মিলবে কবে, কে জানে? অবশ্য রান্নার আছেই বা কী। স্কোয়াসের তরকারি, নইলে থোড়ের চচ্চড়ি দিয়ে ভাত। বাসি ভাত ভেজে হচ্ছে ব্রেকফাস্ট। এমনকী পুলিশের ক্যান্টিনেও সেই একই ছবি।
দেখা হল দার্জিলিং সদর এলাকার একটি সরকারি আবাসনের জনা কয়েক সরকারি কর্মীর সঙ্গে। তাঁরা পরিবারের মহিলা ও শিশুদের সমতলে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিজেদের জন্য চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ কিনে রেখেছিলেন। ক’দিন যেতেই সেই আলুতে বীজ গজিয়ে গিয়েছে। কী খাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তখন স্থানীয় এক কর্মী উপায় বাতলে দেন--কোয়ার্টার চত্বরের কলাগাছ থেকে মোচা, থোড় এনে রান্না হোক। কিন্তু কলাগাছও তো হাতে-গোনা, শেষ হয়ে আসছে ঝাড়। এক আধিকারিকের কথায়, “বনধ আরও চললে কী খেতে হবে, জানি না।”
কালিম্পঙের লোয়ার বম বস্তির কাছে পাহাড়ি ঢালে দেখা গেল, বুনো মানকচু কাটছেন এক দিনমজুর দম্পতি। তাঁদের তিন ছেলেমেয়ে জড়ো করে রাখছিল সেই কচু। মোর্চার মিছিলে যোগ দিয়ে ফেরার পথে এই রসদ সংগ্রহ। কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললেন সুখমায় তামাঙ্গ (নাম পরিবর্তিত)। বললেন, “সামান্য যা টাকা হাতে রয়েছে তা দিয়ে আলু কিনেছিলাম। সব শেষ। এখন মানকচু, স্কোয়াশের ডাঁটা সম্বল। বাচ্চারা কতদিন এ সব খেয়ে সুস্থ থাকবে জানি না।” স্কুল খোলা থাকলে মিড ডে মিলের খিচুড়িটা অন্তত পেত, আক্ষেপ এই দম্পতির।
কার্শিয়াঙে মোর্চার নেতা-কর্মীদের হেঁসেলেও অবশ্য সব্জির আকাল। দলের মিটিং-মিছিল সেরে ফেরার পথে মোর্চার কর্মীদের অনেককেই পাহাড় বেয়ে উঠে স্কোয়াশের ডাঁটা কাটতে দেখা যাচ্ছে। কালিম্পঙে সরকারি কোয়ার্টারের এক আবাসিক বললেন, “সেনা ছাউনিতে সকালে গেলে কিছু আনাজ মেলে। কিন্তু যা ভিড় হয় তাতে অনেককেই খালি হাতে ফিরতে হয়। মাইনে না-পাওয়ায় হাতে টাকাও নেই।” মাইনে হয়নি কেন? কারণ এটিএম পর্যন্ত বন্ধ। দোকানপাট বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদেরও ভাঁড়ারে টান চলছে।
এ ভাবে আর বেশি দিন চললে আমজনতা যে ক্ষোভে ফেটে পড়তে পারেন, তা মোর্চা নেতারা অনেকে একান্তে স্বীকারও করছেন। তাই যে ক’টি সরকারি বাস রোজ শিলিগুড়িতে যাতায়াত করছে, তাতে ভিড় উপচে পড়লেও বাধা দেওয়ার কথা ভাবছেন না তাঁরা। কিন্তু সেই বাসেও জায়গা মেলা ভার। যদি বা জায়গা মেলে, শিলিগুড়ি গিয়ে সে দিনই ফেরা হয়ে ওঠে না। যাঁদের শিলিগুড়িতে আত্মীয়-স্বজন নেই, তাঁরা স্টেশন, বাসস্ট্যান্ডে রাত কাটিয়ে পর দিন ফেরেন।
অবস্থা এমনই যে, এখন পাহাড়ে মরেও শান্তি নেই। পাহাড়ের মানুষজন একান্তে জানালেন, কেউ মারা গেলে তাঁর অন্ত্যেষ্টির আয়োজন করতে মোর্চা নেতাদের পায়ে পড়তে হচ্ছে আত্মীয়দের। নেতাদের নির্দেশ না পেলে যে খুলছে না দশকর্ম ভাণ্ডারও।
মলিন জন্মদিনের অনুষ্ঠানও। বৃহস্পতিবার সকালে মোর্চার মিছিলে গিয়েছিল দুই বন্ধু, যমুনা আর সিনথিয়া। বিকেলে দার্জিলিঙের ম্যালে বসেছিল ষষ্ঠ শ্রেণির ওই দুই ছাত্রী। দু’জনেরই এ দিন জন্মদিন। কিন্তু একটা কেক পর্যন্ত মেলেনি। কোনও মতে কয়েকটা সয়াবিনের প্যাকেট কিনতে পেরেছেন যমুনার মা। তাই দিয়েই রাতে তৈরি হবে ওদের জন্মদিনের ‘স্পেশ্যাল ডিস’।
|
পুরনো খবর: জনজীবন চালু রাখার দায়িত্ব রাজ্য -মোর্চার, নির্দেশ কোর্টের |
|
|
|
|
|