সাত দিন আগে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও পাহাড়ের জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে কেন কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করা হয়নি এই প্রশ্ন তুলে বুধবার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে তিরস্কার করল কলকাতা হাইকোর্ট। প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, জনজীবন স্বাভাবিক রাখা নিয়ে হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছিল, মোর্চা তা সম্পূর্ণ অমান্য করেছে। এই লাগাতার বন্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণ তারা কেন দেবে না, এই প্রশ্নেরও জবাব দিতে বলা হয়েছে বিমল গুরুঙ্গদের। একই সঙ্গে ‘জনতা কার্ফু’ নিয়েও ক্ষোভ জানিয়েছে আদালত।
তবে পাহাড়ে জনজীবন স্বাভাবিক করতে না পারার জন্য রাজ্যকেও ছাড় দেয়নি হাইকোর্ট। ডিভিশন বেঞ্চ মনে করে, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও এই কাজ ঠিক ভাবে করতে পারেনি রাজ্য। বিচারপতিদের নির্দেশ, মোর্চা ও রাজ্যকেই পাহাড়ের জনজীবন সচল রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। |
কলকাতায় হাইকোর্ট যখন এই নির্দেশ দিচ্ছে, তখন পাহাড়ে জনতা কার্ফু অব্যহত। যার ধাক্কায় এ দিনও বেশির ভাগ জায়গাই ছিল সুনসান। এই পরিস্থিতিকে পাহাড়বাসীর ক্ষোভের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ বলেই ব্যাখ্যা করেছেন মোর্চা সম্পাদক রোশন গিরি। তিনি দাবি করেন, “পাহাড়ে এখন তো বন্ধ নেই। গোলমালও নেই। তবু রাজ্য সরকার প্রচুর বাহিনী মোতায়েন করায় পাহাড়বাসী ক্ষুব্ধ। তাই পাহাড়বাসীরা নিজেরাই ‘জনতা-কার্ফু’ সফল করতে ঘর থেকে বেরোচ্ছেন না।” তাঁর অভিযোগ, নানা গোলমাল পাকিয়ে মোর্চাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্র করেছে রাজ্য।
ডিভিশন বেঞ্চ কিন্তু সরাসরি মোর্চাকেই জনজীবন স্বাভাবিক করতে বলেছে। ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, পাহাড়ে ছাত্রছাত্রীরা যাতে নির্ভয়ে স্কুল-কলেজে যেতে পারে, মোর্চাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজ্য সরকারকেও কঠোর হাতে জনজীবনকে স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এ দিন শুনানি চলার সময় প্রধান বিচারপতি জানতে চান, পাহাড়ের মানুষের কাছে ওষুধ, খাবার, জল পৌঁছচ্ছে কি? ছাত্রছাত্রীরা নির্ভয়ে স্কুল-কলেজে যেতে পারছেন কি?
এর পরে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, পার্বত্য এলাকায় দিনের পর দিন মানুষের কাছে জরুরি পরিষেবা, খাবার পৌঁছচ্ছে না। মানুষের অবস্থা পশুর থেকেও খারাপ। সংবিধান মানুষকে যে মৌলিক অধিকার দিয়েছে, পাহাড়ে তার একটিও সুরক্ষিত নয়। এ জিনিস চলতে পারে না। মোর্চা পাহাড়ের যে সব মানুষের জন্য আন্দোলন করছে, সেই মানুষই বিপন্ন। তাঁর মত, বন্ধ উচিত কি অনুচিত, হাইকোর্ট সে প্রশ্নে যাচ্ছে না। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ দিনের পর দিন খাবার, জল, ওষুধের মতো জরুরি জিনিস পাবেন না দেখে হাইকোর্ট চুপ করে থাকতে পারে না। |
জনতা কার্ফুতে সুনসান ঘুম স্টেশন চত্বর। —নিজস্ব চিত্র |
ডিভিশন বেঞ্চের আরও নির্দেশ, ২৯ জুলাই থেকে ১২ অগস্ট পর্যন্ত (যে সময়ের মধ্যে দু’দফায় মোট ১২ দিন বন্ধ হয়েছে) পাহাড়ে সরকারি সম্পত্তির কত ক্ষতি হয়েছে, তা জানাতে হবে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে। এই হিসেব দিয়ে ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে হলফনামা দিতে হবে মোর্চাকে। সেখানে তাদের আরও বলতে হবে, কেন তারা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য নয়।
উচ্চ আদালতের এই রায়ের কথা জানার পরে মোর্চা নেতারা অস্বস্তির মুখে। রোশন গিরি ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাঁরা হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেও যাওয়ার কথা ভাবছেন। রাজ্য সরকারও কিছুটা হলেও অস্বস্তির মুখে। যদিও রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের প্রথম সারির একাধিক কর্তা জানিয়েছেন, সরকার বন্ধ ব্যর্থ করতে সংঘাতের রাস্তায় গেলে পরিস্থিতি আরও অশান্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা। অতীতে জিএনএলএফ-এর আন্দোলনের সময়ে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ পাহাড় দেখেছিল, তার পুনরাবৃত্তি হোক সেটা তাঁরা চাইছেন না বলেই মেপে পা ফেলা হচ্ছে।
তবে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ, যাঁরা আন্দোলনকে স্বাগত জানালেও বন্ধ চান না, তাঁরা হাইকোর্টের নির্দেশের পরে আশায় বুক বাঁধছেন।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব ও খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য দাবি করেছেন, রাজ্যের পক্ষ থেকে পাহাড়কে স্বাভাবিক রাখতে সব রকম পদক্ষেপ করা হচ্ছে। সরকারের যে সদিচ্ছা রয়েছে, তা বোঝাতে দুই মন্ত্রী এ দিন সরকারি বাসে চড়ে কার্শিয়াঙের রোহিণীতে যান। সেখানে গ্রামের ঘরে-ঘরে গিয়ে কথা বলেন। তাঁদের সামনেই কেউ কেউ কতটা শোচনীয় ভাবে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন, সে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে এমন পরিস্থিতি চললেও কেন সরকারের পক্ষ থেকে চাল-ডাল-আনাজ বিলির ব্যবস্থা করা হয়নি, কেন স্কুল-কলেজ, দোকানপাট খোলা রাখার ব্যবস্থা করা যায়নি সেই প্রশ্নও তোলেন কয়েক জন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী ব্যক্তিগত ভাবে কয়েক জনকে অর্থ সাহায্য করেন। বৃহস্পতিবার, স্বাধীনতা দিবসের ছুটি থাকলেও পাহাড়ে যেন রেশন দোকান খোলা রাখা হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে বলে জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানান।
সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, মোট ৩৫১টি পরিবার এ দিন রেশন নিয়েছে। মোট ২৪ কুইন্টাল চাল ও ১১ কুইন্টাল আটাও বিতরণ করা হয়েছে। পাশপাশি পাহাড়ের তিন মহকুমায় ১৫টি সরকারি বাস চলেছে। আজ, বৃহস্পতিবারও এনবিএসটিসি-র বাস চালানো হবে। দার্জিলিং পুলিশের তরফে আরও দাবি করা হয়েছে, গত ১২ দিন ধরে অভিযান চালিয়ে এখনও পর্যন্ত ৩৮০ জন মোর্চা নেতা-কর্মীকে ধরা হয়েছে। যাঁদের মধ্যে সাত জন জিটিএ সভার সদস্য ও অন্তত ১৫ জন মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। হাইকোর্ট ৭ অগস্টই জানিয়েছিল, পাহাড়ে জনজীবন ও জরুরি পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে সরকার ব্যর্থ। নির্দেশ দিয়েছিল, সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। একই সঙ্গে দার্জিলিঙের পুলিশ সুপারকে রিপোর্টও জমা দিতে বলে। এ দিন সেই রিপোর্ট হাইকোর্টে জমা পড়ে। হাইকোর্টের সেই নির্দেশকে হাতিয়ার করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত ১০ অগস্ট মোর্চাকে ৭২ ঘণ্টার চরমসীমা বেঁধে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন। বিমল গুরুঙ্গের পাল্টা হুঁশিয়ারি ছিল, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার না করলে পাহাড়ে জনতা কার্ফু জারি করে পুলিশ ও প্রশাসনকে অকেজো করে দেওয়া হবে। মঙ্গলবার দেখা যায়, জনতা কার্ফু জারি করে মোর্চা পাহাড়কে অচল করে দেয়। জনতা কার্ফুর পক্ষে মোর্চার আইনজীবী অভিজিৎ বসুর দাবি, “পাহাড়বাসীরাই বন্ধ করছেন। স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধ হচ্ছে।” রোশন গিরিরও প্রশ্ন, “পাহাড়বাসী যদি ঘর থেকে না বেরোন, আমাদের দোষ দেওয়া হবে কেন? তেলঙ্গানার দাবি যদি শোনা হয়, তা হলে গোর্খাল্যান্ডের দাবি নিয়ে কেন্দ্র কেন আলোচনা করবে না? আমরা কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাই।”
|
বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন...
উত্তরবঙ্গের বনধ চিত্র |