সে দিন নিয়ম মানা হলে হারাতে হত না চোখটা |
সৌমেশ্বর মণ্ডল • মেদিনীপুর |
২০০৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। সকালেই খবর পেলাম লালগড়ের ঝিটকার জঙ্গলে ক্যান-মাইন পাওয়া গিয়েছে। শুনেই রওনা দিলাম।
প্রথমে বুঝিনি, মাইনটি সদ্য পাওয়া নয়, আগের দিন উদ্ধার হয়েছিল। সে দিন মাইন নিষ্ক্রিয় করতে গিয়েছিল পুলিশ।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি, পুলিশের আধিকারিকেরা হাজির। পৌঁছে গিয়েছেন বম্ব স্কোয়াডের সদস্যরাও। ঝিটকার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গিয়েছে পাকা রাস্তা। রাস্তার দু’দিকে জঙ্গল। মাঝে একটি খালও রয়েছে। শালবনি থেকে লালগড় যাওয়ার পথে খালের কিছুটা আগেই রাস্তার ডানদিকে পোঁতা ছিল বিস্ফোরক ভর্তি স্টিলের ক্যানটি। সেই মাইন নিষ্ক্রিয় করতে নেমে বম্ব স্কোয়াডের সদস্যরা প্রথমে মাপজোক শুরু করলেন। সকলকে জানিয়ে দিলেন, ১০-১২ ফুটের মধ্যে থাকা যাবে না। কোনও গাড়িও রাখা যাবে না। নির্দেশ মানা হল। মাপামাপি শেষ করে ঘটনাস্থলের কিছুটা মাটি সরিয়ে তার খুঁজলেন বোমা বিশেষজ্ঞরা। তারপর স্টিলের ক্যানের একটি অংশের সঙ্গে দড়ি বাঁধা হল। নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে সেই দড়িতে টান মেরে গর্ত থেকে তোলা হল বিস্ফোরক ভর্তি ক্যান। |
|
সে দিন লালগড়ের ঝিটকার জঙ্গলে বিস্ফোরণের ঠিক আগের মুহূর্তে প্রতিবেদকের তোলা ছবি। |
এই পর্যন্ত মাপজোক, দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মানা হলেও এরপর সবই হল ঘরোয়া পদ্ধতিতে। বম্ব স্কোয়াডের সদস্যরা বিশেষ পোশাক পরলেন না। কোনও সরঞ্জাম নিলেন না। দূর থেকে গুলি করে মাইন ফাটানোর চেষ্টাও হল না। উল্টে ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে মাইনের কাছে হাজির হলেন বম্ব স্কোয়াডের কর্মীরা। এক জন বলতে শুরু করলেন, “কাছে এসে দেখুন, শিখে নিন, কী ভাবে মাইন নিষ্ক্রিয় করতে হয়...।” ভীষণ উৎসাহে আমরা সাংবাদিকরা ও পুলিশের অফিসার-কর্মীরা তখন নিয়ম শুনছি। আমি একের পর এক স্ন্যাপও নিচ্ছি। কথা বলতে বলতেই ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে স্টিলের ক্যানের ঢাকনা খুলে ফেললেন ওই বোমা বিশেষজ্ঞ। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল শব্দে কেঁপে উঠল মাটি, চারদিকে কালো ধোঁয়া আর আর্তনাদ।
তারপর আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছিলাম, সে দিন বিস্ফোরণের ধাক্কায় আমি কয়েক ফুট উপরে উঠে পাকা রাস্তায় আছড়ে পড়েছিলাম। ওই ঘটনায় বম্ব স্কোয়াডের সদস্য উৎপল ভক্ত ও জেলা পুলিশের কর্মী বাসুদেব চক্রবর্তীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সাংবাদিক-পুলিশ মিলিয়ে আহত হয়েছিলেন ১৯ জন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর আমি বেঁচে ফিরেছি। তবে একটা চোখ হারাতে হয়েছে। সে দিন যদি সত্যিই বম্ব স্কোয়াডের সদস্যরা নিয়ম মেনে সবাইকে দূরে সরিয়ে দিতেন, নিজেরা উপযুক্ত পোশাক পরতেন, তা হলে কারও প্রাণ যেত না। আমাকেও হারাতে হতো না চোখ। |
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
• একই ভুল, বোমা নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন পুলিশকর্মী |
(প্রতিবেদক আনন্দবাজার পত্রিকার চিত্র সাংবাদিক) |
পুরনো খবর
বিস্ফোরণে দুই পুলিশ নিহত, আহত ২৯ জন |
|