রাত বারোটায়েও ব্যাডমিন্টন কোর্টের ধারে বসে সুনীল গাওস্কর! মুখচোখ থমথমে।
তাঁর থেকে একটু দূরে আওয়াধি ওয়ারিয়র্স টিম বেঞ্চে শিশুর উচ্ছ্বাসে লাফালাফি করছে পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধু। করবে না? আইবিএল ফাইনালে যে স্বপ্নের লাইনআপ! পি ভি সিন্ধুর আওয়াধি ওয়ারিয়র্স বনাম সাইনা নেহওয়ালের হায়দরাবাদ হটশটস।
এবং সেই স্বপ্নের ফাইনাল শনিবার গাওস্করের শহরেই। যাঁর দল মুম্বই মাস্টার্সকেই আজ হাড্ডাহাড্ডি সেমিফাইনালে ৩-২ ম্যাচে হারিয়ে ফাইনালে উঠল সিন্ধুর ওয়ারিয়র্স।
আইবিএলেই টাইন বাউনের বিরুদ্ধে আগের বার জেতার মুহূর্তে সিন্ধু কোর্টের মধ্যেই মহানন্দে শুয়ে পড়েছিল। সেমিফাইনালের মতো নক আউট টাইয়ে বিশ্বের এক নম্বর লি চং প্রথম সিঙ্গলসে শ্রীকান্তকে হারিয়ে মুম্বইকে এগিয়ে দেওয়ার পর সিন্ধু অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন বাউনকে মাত্র ৩৪ মিনিটে স্ট্রেট গেমে ২১-১৬, ২১-১৩ হারিয়ে আওয়াধিকে ১-১ সমতায় এনেও যখন প্রায় উচ্ছ্বাসহীন, প্রাক্তন আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার হিসেবে আমার অবাকই লাগছিল! |
পরে ভেবে দেখলাম, এটাই তো স্বাভাবিক। তিন বারের অল ইংল্যন্ড চ্যাম্পিয়নকে আইবিএলে সিন্ধুর দু’বার হারানোটা বিশাল কৃতিত্ব কোনও সন্দেহ নেই। তবে আঠারো বছরের মেয়ের কাছে মহারথীদের হারানো-টারানোও এখন বোধহয় জলভাত। বিশেষ করে যে ভাবে প্রতিদিনই ও উন্নতি করছে, তার পর। শ্যালক গাওস্করের ব্যাডমিন্টন দলকে সমর্থন জানাতে আজ স্টেডিয়ামে হাজির ছিলেন গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। বলেও দিলেন, “এই প্রথম স্বচক্ষে কোনও ব্যাডমিন্টন ম্যাচ দেখলাম।” তার পরেই সিন্ধু সম্পর্কে তাঁরও মন্তব্য, “ব্রিলিয়ান্ট। প্রতিদিনই উন্নতি করছে।” আর স্বয়ং সিন্ধু বলল, “একদম চাপে ছিলাম না। নক আউট টাই, তবু নার্ভাস না হয়ে নিজের খেলাটাই খেলেছি।”
আসলে সিন্ধু এ দিন একটা নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজি নিয়ে নেমেছিল। খুব সহজ-সরল স্ট্র্যাটেজি বাউনকে বেশি অ্যাটাকিং হয়ে উঠতে দেব না। কোর্ট জুড়ে দৌড় করাব। যাতে সদ্য আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন সার্কিট থেকে রিটায়ার করা ৩৪ বছরের প্রতিদ্বন্দ্বী বেদম হয়ে পড়ে আর তাতে তার বেশি আনফোর্সড এরর হয়। সিন্ধুর প্রতিটা প্ল্যানই দু’টো গেমেই দারুণ ভাবে খেটে যাওয়ায় মহাম্যাচটাও যেন মনে হল টিনএজার হায়দরাবাদি হেসেখেলে জিতল।
ব্যাডমিন্টন মহলের অনেকের মুখে শুনলাম, বাউন আগের দিনই আইবিএলে ব্যবহার হওয়া শাটলের বাড়তি গতি নিয়ে যে অভিযোগ করেছিল, আজ সেই ইস্যুতে প্রতিবাদ জানাতেই কি অত বেশি উঁচু-উঁচু সার্ভিস করছিল? যেগুলোর বেশির ভাগ কোর্টের বাইরে পড়ে একটার পর একটা পয়েন্ট এনে দিল সিন্ধুকে। ধারণাটা ভুল। এ বার যে মেয়েটা ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে সেই রাতনাচক-ও উঁচু সার্ভিস করে। সত্যি বলতে কী, বেশি ভারতীয়রাই শর্ট সার্ভিস করে থাকে। অন্য দেশের ছেলেমেয়েদের তুলনায়।
বরং মুম্বই দলের এ দিনের টিম নামানো নিয়ে তবু প্রশ্ন উঠতে পারে। ভ্লাদিমির ইভানভ ছেলেদের দ্বিতীয় সিঙ্গলসে শ্রীকান্তকে হারিয়ে টাই ২-২ করে মিনিট কয়েক পরেই শেষ মরণ-বাঁচন মিক্সড ডাবলসে নেমে পড়ল। মানছি, রাশিয়ার ছেলেটা স্পেশ্যালিস্ট ডাবলস প্লেয়ার। তা হলেও এই পর্যায়ের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পরপর দু’টো ম্যাচ খেলা যে কারও পক্ষেই প্রচণ্ড কঠিন। মুম্বই কিন্তু গ্রুপ লিগের একটা ম্যাচে মিক্সড ডাবলসে বাউনের সঙ্গে বিশ্বের এক নম্বর লি চংকে নামিয়েছিল। তা ছাড়া ওদের দলের চিফ কোচ লিং চংয়েরই ব্যক্তিগত কোচ। এমন গুরুর তো আরওই বেশি বিশ্বসেরা ছাত্রের ওপর আস্থা থাকা উচিত। বিশেষ করে সেমিফাইনালের মতো গুরত্বপূর্ণ মঞ্চে। |
আওয়াধি দলটার ডাবলস-মিক্সড ডাবলস জুটি দুটো এমনিতেই শক্তিশালী। সম্ভবত টুর্নামেন্টের সেরা। মিক্সড ডাবলসে ওদের ইন্দোনেশিয়ান ভাই-বোন মার্কিস কিডো আর পিয়ার জুটি তাই আজ টাই ২-২ অবস্থায় চূড়ান্ত ম্যাচে ইভানভ-বাউন জুড়িকে স্বচ্ছন্দে ২১-১৯, ২১-১৫ হারিয়ে আওয়াধিকে ফাইনালে নিয়ে গেল। অত মারত্মক চাপের ম্যাচ, ভাই-বোনের খেলায় যেন টেরই পাওয়া গেল না। কিডো মিক্সড ডাবলসে বিশ্বের ন’নম্বর। পিয়া আরও এগিয়ে পাঁচ। পুরুষ ডাবলসে আবার কিডোর আওয়াধি পার্টনার ডেনমার্কের ম্যাথিয়াস বোয়ে-র বিশ্ব র্যাঙ্কিং তিন।
ডাবলসগুলোর জন্যই ফাইনালে আমি সিন্ধুর দলকে এগিয়ে রাখব সাইনার হায়দরাবাদের চেয়ে। তা ছাড়া সাইনা বনাম সিন্ধু মহাযুদ্ধে কে জিতবে কেউ আগাম বলতে পারে না। তবে ফাইনালে হায়দরাবাদ যদি হারেও, তা হলেও আসল ম্যাচটা যে হটশটস-এ ভরা থাকবে সেটা এখনই বলে দিতে পারি।
|