জমি বিলের বিরুদ্ধেই ভোট দিল তৃণমূল
শিল্প না কৃষক শেষ পর্যন্ত কার স্বার্থ রক্ষা হল, সেই বিতর্ক জিইয়েই রইল। কিন্তু দু’পক্ষের জন্যই আজকের বড় খবর, তৃণমূলের আপত্তি সত্ত্বেও অবশেষে বিজেপি এবং বামেদের সমর্থন আদায় করে লোকসভায় আজ নতুন জমি বিল পাশ করালো মনমোহন সিংহ সরকার।
কেন্দ্রের নতুন জমি বিল অনুযায়ী, বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্বসম্মতি নিতে হবে অন্তত আশি শতাংশ জমির মালিকের। কিন্তু তৃণমূলের তরফে সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আজও লোকসভায় বলেন, “শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকবে না। জোর করে জমিও নেওয়া যাবে না। কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সরাসরি একশো ভাগ জমি তাঁদের কাছে কিনতে হবে বেসরকারি শিল্প সংস্থাকে। তাতে মাথা গলাবে না রাজ্য সরকার।”
তৃণমূলের সেই উদ্বেগ নিরসন করতে গিয়ে দেড় বছর আগেই কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েছিলেন, ‘৮০ শতাংশের’ বিধি কেন্দ্রের বিলে থাকলেও, রাজ্য চাইলে পুরোটাই কৃষকদের উপরে ছেড়ে দিতে পারে। সেই আশ্বাসটি আজও জয়রাম বারবার লোকসভায় পুনরাবৃত্তি করেন। সম্ভবত, সে জন্যই এক সময় সৌগত রায় জানিয়েছিলেন, তাঁরা বিলটি সমর্থন করবেন। কিন্তু পরে পুরনো অবস্থানেই ফিরে যায় তৃণমূল। লোকসভায় সুদীপবাবু জানিয়ে দেন, মূল বিলে ৮০ শতাংশের শর্ত থেকেই যাচ্ছে। তাই তাকে সমর্থন করতে পারবে না তাঁদের দল।
মূল বিল যে তৃণমূল সমর্থন করবে না, সেটা কলকাতায় মহাকরণে স্পষ্ট করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “আগে ছিল ৩০ শতাংশ, এখন বলছে ২০ শতাংশ। ৩০-ও যা, ২০-ও তাই।” সংসদের বাইরে এ দিন সিপিএম সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া বলেছেন, “সরকারের উপস্থিতি না থাকলে মাফিয়ারা জমি দখল করবে।” এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে মমতার বক্তব্য, “আমি ওঁদের দলের লিডার নই। মাফিয়ারা দখল করলে ৮০ শতাংশ করে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে এই সমস্যা হয়েছিল।”
অধিগ্রহণ নীতি
শিল্পের জন্য অধিগ্রহণে কমপক্ষে ৮০% এবং যৌথ প্রকল্পে ৭০% জমি-মালিকের সম্মতি
কোনও রাজ্য চাইলে শিল্পের ক্ষেত্রে অধিগ্রহণ পুরোটাই বাজারের উপরে ছাড়তে পারে
শহরে জমির দামের দ্বিগুণ এবং গ্রামে চার গুণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে
ক্ষতিপূরণ ও প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত উচ্ছেদ নয়
অধিগ্রহণের পর পাঁচ বছরের মধ্যে কাজ শুরু না হলে জমি ল্যান্ড-ব্যাঙ্কে
বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ করা যাবে কি না বা কতটা যাবে, তা ঠিক করবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য
এই পরিস্থিতিতে দিনের শেষে ভোটাভুটিতে তৃণমূল বিলের বিরুদ্ধেই ভোট দেয়। যে ১৯টা ভোট বিরুদ্ধে পরে, তার ১৮টিই পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের। বাকিটা? বাম শরিক আরএসপি-র।
দিনের শেষে সংসদে জমি বিলের এই মসৃণ গতিপথটা অবশ্য উপাখ্যানের একমাত্র পরিচ্ছদ নয়। বরং গত সাত বছর ধরে দেশ জুড়ে তুমুল বিতর্ক চলেছে জমি অধিগ্রহণ নীতি নিয়ে। বিজেপি, সিপিএম, তৃণমূল-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শিল্প সংস্থা, কৃষক সংগঠনের তরফে এসেছে গুচ্ছ প্রস্তাব। ফলে সর্বসম্মতি গড়তে গিয়ে সরকারকেও জমি ছাড়তে হয়েছে অনেকটা। দু’বছর আগে সংসদে যে জমি বিল পেশ করেছিল সরকার, তার নাম থেকে শুরু করে চরিত্রে ১৫৭টি সংশোধন করে মাত্র এক মাস আগে প্রায় সর্বসম্মতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয় কংগ্রেস। এর মধ্যে বিজেপি ও বামেদের আনা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়েছে। তাই আজ জমি বিল পাশে বেগ পেতে হয়নি সরকারকে।
জমি বিলে বিজেপি-র সমর্থন জানানোও রাজনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বইকি। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-ও দেখাতে চাইল যে, তারা কৃষক স্বার্থের বিরুদ্ধে নয়।
তবে বিরোধীদের সমর্থন নিয়ে বিল পাশ করালেও খাদ্য সুরক্ষার পর এখন জমি বিল নিয়েও কৃতিত্ব নিতে নেমে পড়েছে কংগ্রেস। এমনকী, জমি বিলের জন্য রাহুল গাঁধীকে কৃতিত্ব দেওয়ার প্রয়াসও শুরু করে দিয়েছেন কংগ্রেস নেতারা।
কিন্তু কী বলা হল নয়া জমি বিলে?
গোড়াতেই জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ বিলটিতে সংশোধন প্রস্তাব এনে ২০০৯ সালে এক বার তা লোকসভায় পাশ করিয়েছিল ইউপিএ-১ সরকার। কিন্তু রাজ্যসভায় তা পাশ না হওয়ায় সেই সংশোধন খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ইউপিএ-২ জমানায় ১১৯ বছরের পুরনো আইনটি সংশোধন না করে তা একেবারে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পরিবর্তে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের জন্য তৈরি হয় নতুন জমি নীতি। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নিয়মগিরি পাহাড়, ভাট্টা পারসলে সেই বার্তা পৌঁছে দিতে তার নাম রাখা হয়, ‘স্বচ্ছতার সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ এবং সেজন্য ন্যায্য পুনর্বাসন ও পুনর্স্থাপন বিল’। সেই সঙ্গে জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণের সংজ্ঞাও পরিবর্তন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জনস্বার্থে সরকারি প্রকল্পের জন্য সরকার নিজেই জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে। জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য আপৎকালীন ভিত্তিতে জমি অধিগ্রহণের এক্তিয়ারও সরকারের থাকবে। তা ছাড়া বেসরকারি সংস্থা কোনও শিল্প তৈরির জন্য কমপক্ষে আশি শতাংশ কৃষকের সম্মতি নিয়ে ফেললে বাকি জমি অধিগ্রহণে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে। এরই পাশাপাশি তফসিলি উপজাতি এলাকায় জমি অধিগ্রহণে স্থানীয় গ্রামসভার অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বিলে। সেই সঙ্গে দেশ জুড়ে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে কৃষক অসন্তোষের প্রেক্ষিতে পুনর্বাসন ও পুনর্স্থাপন প্রকল্পের বিস্তৃত ব্যবস্থাও করা হয়েছে নতুন জমি বিলে। এর পরেই ওঠে সেই প্রশ্ন: এই জমি বিলে শিল্পের স্বার্থ রক্ষা হবে, নাকি কৃষকের? শিল্প তথা বণিক মহল আগেই বিলের বিরোধিতা করেছে। আবার বিল নিয়ে বিতর্কে অংশ নিয়ে বিজেপি থেকে শুরু করে বাম ও তৃণমূল নেতারা জানিয়েছেন, বিলটিতে যতটা কৃষক স্বার্থ রক্ষা করা উচিত ছিল, ততটা হয়নি। বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহের কথায়, তাঁরা বিলে সমর্থন জানাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু কৃষক স্বার্থে বিলটিতে আরও সংশোধন আনার বিষয়টি ছেড়ে দিচ্ছেন সরকারের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন।
বিরোধী শিবিরের এই বক্তব্যকেই অস্ত্র করে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ এ দিন বলেন, “কৃষক সংগঠনগুলি বলছে নয়া বিলে প্রগতিশীল তথা শিল্পের স্বার্থ দেখা হয়েছে। আর শিল্প কর্তারা বলছেন, বিলটি তাঁদের জন্য কঠোর হয়ে গেল। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে বিলে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা হয়েছে।” তাঁর কথায়, “কোনও বিষয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে যাওয়ার একটাই ঝুঁকি। তা হল, কাউকেই খুশি করা যায় না।”
জয়রাম আজ তাঁর জবাবি বক্তৃতায় আরও জানান, কী ভাবে বিলটিকে সর্বসম্মত করে তুলতে তাঁকে স্থায়ী কমিটির ১৩টি সুপারিশ মানতে হয়েছে। সুষমা স্বরাজের দু’টি সুপারিশও মেনে নিয়েছেন তিনি। এর মাধ্যমে শিল্পমহলের উদ্দেশে কংগ্রেস এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন, এর থেকে বিলটি লঘু করার ক্ষমতা সরকারেরও ছিল না। তাতে বিল পাশ হত না। অন্য দিকে কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা বলেন, যা হয়েছে তা মন্দের ভাল। কারণ, এর ফলে এখন তা-ও কিছুটা দিশা দেখা যাচ্ছে।
তবে শিল্পমহলের প্রতিনিধিদের বক্তব্য, শেষমেশ যে জমি বিল আজ পাশ হয়েছে, তাতে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আরও জটিল হতে বাধ্য। যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে প্রকল্প তৈরির খরচ বেড়ে যাবে। জমির মূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়াও অযথা জটিল করা হয়েছে।
তা হলে কাদের দেখা হল? শিল্পমহল না চাষি? ঘরোয়া আলোচনায় সরকারেরই এক শীর্ষ সারির মন্ত্রী বলেন, তা বোঝা যাবে অন্তত ছ’মাস পর। যখন নতুন আইনের বাস্তবায়ন শুরু হবে। তবে তার আগে রাজনৈতিক ভাবে কংগ্রেস জমি বিলে জটিলতা কাটানোর কৃতিত্ব যেমন নিতে পারবে, তেমনই কৃষকদের বোঝাতে পারবে, তাঁদের কী বিপুল ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিল কেন্দ্র।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.