রাজ্য ও মোর্চার মাঝে লেপচাদের উভয়সঙ্কট
যেন শাঁখের করাত।
এগোতে গেলে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার রোষের ভয়। পিছোতে গেলে বিলক্ষণ চটবে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘লেপচা-বন্ধু’ সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে উভয়সঙ্কটে পড়েছেন দার্জিলিং পাহাড়ের লেপচারা। এ কথা তাঁরা অনেকে স্বীকারও করছেন একান্তে।
লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ গড়ে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতেই মুখ্যমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লেপচারা। রাজ্যও তাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী লেপচাদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেপ্টেম্বরের গোড়ায় পাহাড়ে যাবেন বলে ঘোষণাও করেছেন। কিন্তু কোথায় হবে সেই অনুষ্ঠান, গোল বেঁধেছে তা-ই নিয়ে।
সরকারি সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী চান সংবর্ধনা দেওয়া হোক পাহাড়েই। সে ক্ষেত্রে দার্জিলিং বা কালিম্পংই তাঁদের পছন্দ। কিন্তু কালিম্পঙের লেপচা সংগঠনের অনেকেই জানাচ্ছেন, মোর্চা শিবির থেকে তাঁদের ফোন করে কড়া ভাষায় পাহাড়ে ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান না করতে বলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও লেপচা নেতাদের বাড়ি বয়েও একই কথা বলে আসা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীকে একান্তই যদি সংবর্ধনা দিতে হয়, সেটা শিলিগুড়িতে ‘চুকিয়ে ফেলার’ পরামর্শও দেওয়া হয়েছে উদ্যোক্তাদের। যদিও প্রকাশ্যে মোর্চা নেতৃত্ব এই অনুষ্ঠান নিয়ে উদাসীনতা দেখাচ্ছেন। বুধবারও কালিম্পঙের মোর্চা বিধায়ক হরকাবাহাদুর ছেত্রী বলেছেন, “এটা লেপচাদের আর মহাকরণের মধ্যেকার ব্যাপার। আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। পাহাড়ের মানুষ সবই বোঝেন।”
লেপচা সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। —ফাইল চিত্র
এই অবস্থায় লেপচা সংগঠনের এক পক্ষ চাইছেন, পাহাড়ের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না-হওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠান স্থগিত রাখা হোক। অন্য পক্ষ চাইছেন, প্রথমে যেমন ঠিক হয়েছিল, শিলিগুড়ির বাঘা যতীন পার্কে অনুষ্ঠান হোক। কিন্তু পাহাড় থেকে সমতলে অনুষ্ঠান সরানোর ব্যাপারে তৃণমূল নেতৃত্বের সায় নেই। অতীতে মোর্চার চাপের মুখে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দলীয় অনুষ্ঠান (প্রকাশ্য সমাবেশ ও জেলা সম্মেলন) রাতারাতি পাহাড় থেকে শিলিগুড়িতে সরিয়ে নিয়েছিল সিপিএম। সেই ঘটনা নিয়ে এখনও সিপিএম নেতাদের ঘরে-বাইরে সমালোচনা শুনতে হয়। তৃণমূল স্বভাবতই সেই ঝুঁকি নিতে চায় না। ফলে দু’দিক থেকে চাপে পড়ে লেপচারা অনেকটাই দিশাহারা। অথচ তাঁদের যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা, রাজ্য সরকারের তরফে প্রায়ই জানতে চাওয়া হচ্ছে কবে, কোথায় সংবর্ধনার দিন স্থির করা হল।
লেপচাদের এই উভয়সঙ্কটের সূচনা ১২ ফেব্রুয়ারি লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ গঠনের সময় থেকেই। লেপচা সম্প্রদায়ের ভাষা, শিক্ষা-সংস্কৃতি-স্বাস্থ্য সহ নানা বিষয়ে উন্নতির জন্য কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ করে রাজ্য। কিন্তু মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গের বক্তব্য ছিল যেহেতু অনগ্রসর কল্যাণ বিভাগ জিটিএ-র আওতায় হস্তান্তর হয়েছে, সে জন্য লেপচা জনজাতির জন্য কোনও পর্ষদ গড়তে হলে তাঁরাই গড়বেন। পাশাপাশি, জিটিএ-কে অন্ধকারে রেখে ওই বোর্ড গড়ে রাজনৈতিক ‘বিভাজন’ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন গুরুঙ্গ। এই দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যে পড়ে যান দার্জিলিং জেলার লেপচারা।
পাহাড়ে লেপচাদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার, মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। তার মধ্যে শুধু কালিম্পঙেই থাকেন লেপচা সম্প্রদায়ের প্রায় এক লাখ মানুষ। কালিম্পঙের অল ইন্ডিয়া ইন্ডিজেনাস লেপচা অ্যাসোসিয়েশনই মুখ্যমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দিতে আগ্রহী। লেপচাদের আর একটি সংগঠন রয়েছে দার্জিলিংয়ে। মোর্চার সুরে সুর মিলিয়ে
তাঁরা অবশ্য চান, লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ জিটিএ-র হাতেই থাক। অর্থাৎ মতভেদ রয়েছে লেপচাদের মধ্যেও।
অবস্থা এমনই যে, ২৩ অগস্ট উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের কলেজপাড়ার বাড়িতে লেপচা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা এক ঘণ্টা বৈঠক করেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। শুধু তাই নয়, বৈঠক শেষে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লেপচা সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধি জানান, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মান জানাতে চান ঠিকই। কিন্তু তাই বলে পাাহাড়ের অন্য কোনও সম্প্রদায়ের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়, এমন কোনও পদক্ষেপ তাঁরা করবেন না। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে ঘিরে গোর্খা-লেপচা, মোর্চা-তৃণমূল এবং লেপচাদের নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে ফাটল চওড়া করার পক্ষপাতী নন তৃণমূল নেতারাও। তাই শেষ পর্যন্ত সমতলেই অনুষ্ঠানে রাজি হতে পারে রাজ্য এই সম্ভাবনাও খারিজ করে দেওয়া যাচ্ছে না। বুধবার গৌতম দেব বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী কবে আসবেন তা এখনও ঠিক হয়নি। প্রথমে পাহাড়ে যাবেন, না শিলিগুড়িতে কোনও অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন, সে সব সূচি এখনও ঠিক হয়নি।” প্রথমে ঠিক হয়েছিল ২ সেপ্টেম্বর, পরে বলা হয় ১০ সেপ্টেম্বর। এখন তার মাঝামাঝি কোনও একটা দিন অনুষ্ঠান রাখতে চাইছে রাজ্য।
লেপচারা চেয়েছিলেন প্রদীপ জ্বেলে ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের মধ্যে দিয়ে বরণ করে নেবেন মুখ্যমন্ত্রীকে। মহড়া শুরু হয়েছে। কচি বাঁশপাতা, ঘিয়ের প্রদীপ সবই তৈরি। কিন্তু কোথায় সেই প্রদীপ জ্বলবে, কোথায় নাচবেন লেপচা ছেলেমেয়েরা, রাজনীতির অস্থিরতায় সেই জায়গাটাই এখনও স্থির করা গেল না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.