সুফল/২
অর্থ দফতর বেড়ি খুলতেই গতি এল প্রকল্পে
র্থ দফতরের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থেকে সরিয়ে দফতরগুলিকে স্বাধীন ভাবে টাকা খরচের ক্ষমতা দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। দু’বছরের মধ্যেই তার সুফল ফলতে শুরু করেছে। মহাকরণের খবর, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসের জন্য পরিকল্পনা খাতে মোট যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, তার ৮৩ শতাংশই পৌঁছে গিয়েছে তৃণমূল স্তরে। অর্থ দফতরের কর্তাদের মতে, বিকেন্দ্রীকরণের এমন নজির আগে দেখেনি এ রাজ্য।
রাজ্যের নিজস্ব উন্নয়ন প্রকল্পগুলি কেমন চলছে, তা বুঝে নিতে গত ২০ অগস্ট মন্ত্রী-আমলাদের বৈঠকে ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে যে ছবি উঠে এসেছে তার নির্যাস হল এ বছর এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ মোট অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৫৭৫ কোটি টাকা খরচের অনুমোদন পৌঁছে গিয়েছে একেবারে নীচের ধাপে। সেই টাকায় প্রকল্প তৈরির কাজ শুরুও হয়েছে। ১১টি দফতর এক ধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় কিস্তির টাকা খরচের অনুমোদনও পাঠিয়ে দিয়েছে। এই কিস্তিতে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসের জন্য ৫০ শতাংশ বরাদ্দ খরচের ছাড়পত্র দেয় অর্থ দফতর। অগস্টের গোড়ায় সেই ছাড়পত্র দিয়েও দিয়েছে তারা। ফলে টাকা আসবে ধরে নিয়ে দফতরগুলি তার আগেই খরচের অনুমোদন পাঠিয়ে দিয়েছে নিচুতলায়।
অথচ বাম আমলে ছবিটা এমন ছিল না। মহাকরণ সূত্রের খবর, তখন বাজেট বরাদ্দ হলেও টাকার উপরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকত অর্থ দফতরেরই। দফতরগুলি বাজেটে উল্লিখিত প্রকল্প জমা দিলে তা খতিয়ে দেখার পরে অর্থ মঞ্জুর করত তারা। প্রশাসনের একটি অংশের মতে, প্রকল্প জমা দেওয়ার পরেও টাকা পেতে দফতরগুলির কালঘাম ছুটে যেত। অনেক সময় টাকা পাওয়া যাবে এই আশায় কাজ শুরু করে দিয়ে মাঝপথে পস্তাতে হতো। টাকা না-পেয়ে কাজ বন্ধ করে দিতেন ঠিকাদাররা।
অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “আগের জমানায় বছর শেষে যখন টাকা দেওয়া হতো, তখন তা খরচ করার উপায় থাকত না। বছরের পর বছর এ ভাবেই চলত। বাজেটে ঢাক পিটিয়ে উন্নয়ন খাতে বিরাট অঙ্কের টাকা দেওয়ার কথা বলা হলেও, তা হাতে পেতে নাজেহাল হতেন মন্ত্রীরা।” দফতরের আর এক কর্তার মন্তব্য, “তখন অর্থ দফতর পরিকল্পনা খাতের টাকা যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখত। ফলে বছর ঘুরে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে টাকা খরচ তো দূরের কথা, জেলাস্তর পর্যন্তও তা নামত না। প্রায় প্রতিবারই বাজেটে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ হতো, বাস্তবে খরচ হতো তার অনেক কম।”
সেই সময় বামফ্রন্টের অধিকাংশ মন্ত্রীই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের উপর এ নিয়ে রুষ্ট ছিলেন। তাঁরা বার বার অথর্মন্ত্রীর কাছে গিয়েও টাকা বের করতে পারতেন না বলে জানিয়েছেন ওই কর্তা। যে বাজেট বরাদ্দ মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে, বিধানসভায় পাশ হয়েছে, তা অর্থ দফতর কেন আঁকড়ে বসে থাকবে, সেই প্রশ্ন তখন বার বার উঠেছে।
দফতর বাজেট বরাদ্দ প্রথম কিস্তি খরচের অনুমোদন*
পরিকল্পনা ২৫৭ ৬৪.২৫ ১০১.৮২
বন ১৭৯.৮২ ৪৪.৯৬ ৭৭.৩৭
পার্বত্য বিষয়ক ১৩০.২৭ ৩২.৫৭ ১০৯.৪৪
জনস্বাস্থ্য কারিগরি ৯১০ ২২৭.৫ ৩৩৭.৮২
পঞ্চায়েত ২৯৯০.৩৭ ৭৪৭.৫৯ ১৩৬৭.৪২
অনগ্রসর শ্রেণি উন্নয়ন ৫২৩.২৪ ১৩০.৮১ ২৬২.৭৯
হিসেব কোটি টাকায় *১৯ অগস্ট পর্যন্ত
বাজেট বরাদ্দ আর বাস্তবে তা খরচের প্রশ্নে বাম সরকার যে পিছিয়ে ছিল, সেটা তাদের শেষ দু’বছরের পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট। ২০১০-’১১ সালে অসীমবাবু তাঁর বাজেটে পরিকল্পনা খাতে ১৯ হাজার ৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। বাস্তবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ১১ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা খরচের। অর্থাৎ, রাজ্যের নিজস্ব উন্নয়ন খাতের ৭২৩২ কোটি টাকা দফতরগুলিকে দেওয়া হয়নি। ২০১১-’১২ সালের ভোট-অন-অ্যাকাউন্টে তিনি ২০ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকার পরিকল্পনা বরাদ্দ পেশ করেছিলেন। মে মাসে তৃণমূল ক্ষমতায় এসে অসীমবাবুর পথেই চলেছিল। ফলে বছর শেষে বাস্তবে বরাদ্দ হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ৬৮৭৫ কোটি টাকা দেওয়াই করা হয়নি।
নতুন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এই পদ্ধতিটাই পাল্টে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হল, অর্থ দফতরের কাজ সব কিছুর নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে থাকা নয়। বাজেট প্রস্তাবে দফতরগুলিকে যখন বরাদ্দ নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তখন তাদের প্রাপ্য টাকা অর্থ দফতর অকারণে আটকে রাখবে কেন? ১২-’১৩ সালে প্রথম বার পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশের সময় অমিতবাবু পরিকল্পনা খাতে ২৩ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন। বছর শেষে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ২৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বরাদ্দ ছাঁটাই হয় মাত্র ৩৪২ কোটি টাকা (প্রকৃত খরচের হিসেব অবশ্য এখনও মেলেনি)।
শুধু তা-ই নয়, টাকা খরচে দফতরগুলিকে বাড়তি স্বাধীনতা দিতে বাজেট বরাদ্দের পরে খরচে অদলবদলের প্রয়োজন হলে অর্থ দফতরের অনুমোদন নেওয়ার ব্যবস্থা তুলে দিয়েছেন অমিতবাবু। পাশাপাশি, বাজেট বরাদ্দের মধ্যে যে কোনও প্রকল্পের ছাড়পত্র দেওয়ার অধিকারও দেওয়া হয়েছে দফতরের সচিবদের। অর্থ দফতরের কর্তারা জানান, বাজেট পাশ হয়ে যাওয়ার পরে তাঁরা আর পরিকল্পনা খাতের টাকার মালিক থাকেন না। দফতরের সচিবই এখন টাকা খরচের অনুমোদন দেন। আর্থিক সংস্কারের এই প্রক্রিয়াটি প্রাক্তন মুখ্যসচিব সমর ঘোষের হাত ধরে শুরু হলেও অমিতবাবু তার রূপায়ণে যত্নশীল হয়েছেন।
এই আর্থিক সংস্কারের জেরে চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে পরিকল্পনা বরাদ্দের ২৫% অর্থ খরচের ক্ষমতা এপ্রিল মাসেই পেয়ে গিয়েছেন রাজ্যের ৬৮টি দফতরের সচিবরা। ১ অগস্ট দেওয়া হয়েছে পরের ৬ মাসে আরও ৫০% অর্থ খরচের স্বাধীনতা। টাকা কী ভাবে খরচ হচ্ছে তা ‘প্ল্যান রিলিজ ইনফরমেশন সিস্টেম’ সফটওয়্যারে ঘোষণা করতে হচ্ছে দফতরগুলিকে। তাতেই বোঝা যাচ্ছে তারা টাকা নিজের কাছে রেখেছে, নাকি নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করেছে।
সরকারি তথ্য বলছে, প্রথম ত্রৈমাসিকে বরাদ্দ অর্থের ৮৩% একেবারে নীচের স্তরে পাঠিয়ে দিয়েছে দফতরগুলি। এর মধ্যে ১১টি দফতর প্রথম কিস্তির সব টাকা তো বটেই, দ্বিতীয় কিস্তির টাকা খরচের ছাড়পত্র হাতে পাওয়ার আগেই তার একটা বড় অংশ খরচের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে নিচুতলাকে। ১৫টি দফতর প্রথম কিস্তিতে পাওয়া টাকার ৫০% খরচের অনুমোদন দিয়েছে। বাকি ৪২টি দফতরের কাজ অবশ্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
অর্থ দফতরের কর্তারা জানান, বন, স্বরাষ্ট্র, পার্বত্য উন্নয়ন, পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য কারিগরি, বিদ্যুৎ, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন, পূর্ত (সড়ক), অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ, উন্নয়ন ও পরিকল্পনা এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠী উন্নয়নের মতো দফতর নিচুতলাকে খরচের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে সব চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
বাম জমানায় অর্থ দফতরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এক কর্তার অবশ্য মত, অমিতবাবু যে সংস্কারের দাবি করছেন, তা বাম আমলেই শুরু হয়েছিল। আর পরিকল্পনা খাতের টাকা বরাদ্দের ক্ষেত্রে অর্থ দফতরের সতর্ক থাকা উচিত। ওই কর্তা জানাচ্ছেন, বাম আমলে বছরের শুরুতে সেচ বাঁধ নির্মাণ ও সারাই, সামাজিক বনসৃজন, খরিফ চাষের জন্য যাবতীয় টাকা দেওয়া হতো। কারণ, বর্ষার সঙ্গে এগুলির যোগ রয়েছে। স্কুলের বই কেনা, ক্লাসঘর নির্মাণ, রাস্তা সারাইয়ের মতো কাজের টাকা দেওয়া হতো পুজোর পর। কারণ, বর্ষার পরেই নির্মাণ কাজ করার চল রয়েছে রাজ্যে। সমস্ত দফতরকে একসঙ্গে টাকা ছেড়ে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলেই মনে করেন তিনি।
পাশাপাশি তাঁর যুক্তি, টাকা ছাড়লেই তো হল না, তা উপযুক্ত ভাবে খরচ হচ্ছে তো? সেই পর্যালোচনাটা বেশি জরুরি। যে ভাবে মুখ্যমন্ত্রী সবার সামনে মন্ত্রী-আমলাদের ধমকাচ্ছেন তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না। তবে এখন যে ভাবে রাজস্ব বেড়েছে, তাতে পরিকল্পনা বরাদ্দ ছাড়ার ক্ষেত্রে কৌশলী হলে অর্থমন্ত্রীকে বাজার থেকে বিপুল ঋণ নিতে হতো না বলেই মনে করছেন ওই কর্তা।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.