|
|
|
|
মুখ্যমন্ত্রীকে শুধু মঞ্জুরির তথ্য |
উন্নয়নে টাকা ছাড়ার ধুম, খরচ কোথায় |
দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
একটা শুধু এসএমএস।
তাতেই পরিকল্পনা খাতে টাকা ছাড়ার হার এক ধাক্কায় বেড়ে গেল অন্তত কুড়ি শতাংশ! সেই তথ্য হাতে নিয়েই রাজ্যের ‘উন্নয়নের ছবি’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে পেশ করলেন বিভিন্ন দফতরের সচিবেরা। কিন্তু খরচের অনুমতি দেওয়া (চালু ভাষায় টাকা ছাড়া), আর উন্নয়নে তা খরচ হওয়ার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, সে তথ্যটা কার্যত উহ্য রইল।
মহাকরণের খবর: শুক্রবার দুপুরে সব দফতরের সচিবকে মোবাইলে একটি এসএমএস পাঠায় অর্থ দফতর। পরে যায় মেল-বার্তা। তাতে বলা হয়, মঙ্গলবার দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী তিন দফায় সচিবদের নিয়ে বৈঠক করবেন। উন্নয়ন খাতে কোন দফতর কী কাজ করেছে, কত টাকা খরচ করেছে, বৈঠকে তার হিসেব দাখিল করতে হবে।
তাই সোমবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে ‘টাকা ছাড়া’র চূড়ান্ত সময় বেঁধে দেয় অর্থ দফতর। টাকা ছাড়ার ধুম পড়ে যায়।
“পরিকল্পনা খাতে কে কত বেশি টাকা খরচের অনুমতি দিতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন দফতর রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে।” জানাচ্ছেন অতিরিক্ত মুখ্যসচিব পদমর্যাদার এক অফিসার। ফলে শুক্রবার সকালেও যেখানে উন্নয়ন খাতে টাকা ছাড়ার হার ছিল ৪০ শতাংশের কম, আটচল্লিশ ঘণ্টার তফাতে, অর্থাৎ সোমবার বিকেলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ শতাংশে! যদিও সরকারি হিসেব মোতাবেক, চলতি অর্থবর্ষে (২০১২-১৩) এ পর্যন্ত পরিকল্পনা খাতে মোট বরাদ্দের মধ্যে খরচ হয়েছে সাকুল্যে ৩২ শতাংশ!
এ অবস্থায় টাকা যতই ছাড়া হোক, অর্থবর্ষের বাকি মাস দেড়েকের মধ্যে প্রকৃত উন্নয়ন কতটা হবে, তা নিয়ে সরকারি মহলেই প্রবল সংশয়। রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তার দাবি: মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সচিবেরা যে তথ্য দাখিল করেছেন, তা মূলত পরিকল্পনা খাতে প্রকল্পপিছু টাকা ছাড়ার হিসেব। উন্নয়নের খতিয়ানের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।
মহাকরণের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “প্রতি দফতরের জন্য পরিকল্পনা খাতের টাকা বাজেটে ধরা থাকে। অর্থ-অফিসারদের অনুমোদনক্রমে দফতর স্থির করে, কোন প্রকল্পে কী ভাবে কত টাকা খরচ হবে। সেই মতো নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচের অনুমতি মঞ্জুর হয়। এটাই হল টাকা ছাড়া।” প্রকল্পের কাজ হওয়ার পরে বিল পাশ হলে ট্রেজারি ওই অনুমোদিত অর্থ মিটিয়ে দেয়। “তখনই বলা যায়, টাকা খরচ হয়েছে। উন্নয়ন হয়েছে।” বলেন ওই কর্তা।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার চলতি অর্থবর্ষে পরিকল্পনা খাতে ২৩ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। তার মধ্যে সব দফতর মিলে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা ‘ছেড়েছে’ বলে অর্থ দফতর মুখ্যমন্ত্রীর অফিসকে জানিয়েছে। আনুপাতিক হিসেবে যা প্রায় ৬১%। কিন্তু অর্থবর্ষের দশ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ৩২ শতাংশের বেশি খরচ করে ওঠা গেল না কেন?
একাধিক সচিবের অভিযোগ: বছরের যে সময়টায় সবচেয়ে বেশি কাজ হয়, সেই সেপ্টেম্বর-জানুয়ারিতেও বহু প্রকল্পের ফাইল অর্থ দফতরে পড়ে ছিল। অনেক প্রকল্প মাঝপথে থমকে থাকে, বেশ কিছু শুরুই করা যায়নি। এক পূর্ত-কর্তা বলেন, “মাস তিনেক আগে যে সব রাস্তা ও সেতু তৈরির বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) জমা দিয়ে টাকা ছাড়ার আর্জি জানিয়েছিলাম, সম্প্রতি সেগুলোর অনুমোদন মিলেছে। অর্থ দফতর লেটার অফ ক্রেডিট’ আটকে রেখেছিল। এখন টাকা পেয়ে কতটা কাজ করা যাবে, জানি না।” সেচের একাধিক কর্তার মুখেও একই অভিযোগ। অর্থ-কর্তারা কী বলছেন?
তাঁরা উল্টে দায় ঠেলছেন অন্যান্য দফতরের উপরে। ওঁদের বক্তব্য: অধিকাংশ দফতরে ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইসার নিয়োগ করা হয়েছে, যাঁরা অর্থের অনুমোদন ছাড়াই দশ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচের অনুমতি দিতে পারেন। তা সত্ত্বেও অনেক দফতর প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করে জমা দিতে পারেনি বলে অর্থ-কর্তাদের একাংশের অভিযোগ।
রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তার মতে, পরিকল্পনা খাতে কোন দফতর কত টাকা খরচ করছে, তা দিয়ে একটা সরকারের অভিমুখ বোঝা যায়। এবং এ ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেচ ইত্যাদিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে তাঁরা মনে করছেন। যদিও অর্থ দফতরের হিসেব বলছে, ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেচ ৩৪%, স্বাস্থ্য ৩৭%, খাদ্য ২০% ও শিক্ষা দফতর ৪৮ শতাংশের বেশি টাকা ছাড়তেই পারেনি। কাজ হওয়া দূরের কথা!
পরিকল্পনা খাতে খরচের ছবিটা বিবর্ণ হলেও পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাতে অবশ্য এখনই চারশো কোটির বেশি খরচ করে ফেলেছে রাজ্য সরকার। সচিবদের একাংশের আক্ষেপ, মেলা-উৎসব, দান-খয়রাতি ও নানান জাঁকজমকের পিছনেই কোটি কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। ঋণের রাস্তাও কার্যত বন্ধ, কারণ এ বছরে ইতিমধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ রাজ্য নিয়ে ফেলেছে। ঋণ-কোটায় বাকি মাত্র আড়াই হাজার কোটি।
এ অবস্থায় উন্নয়ন কতটা হবে, তা সময়ই বলবে। তবে উন্নয়ন খাতে টাকা ছাড়ার দৌড়ে রাজ্য এখনই গত বছরকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। মহাকরণের নথি অনুযায়ী, গত অর্থবর্ষে রাজ্যে পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ ছিল ১৪ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যার ৫৫% খরচের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। চলতি অর্থবর্ষে মাস দেড় বাকি থাকতেই যা ৬১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে!
কিন্তু গত বছরে প্রকৃত খরচ কত হয়েছিল?
এখনও হিসেব কষছেন অর্থ-কর্তারা।
|
ভাগের খাতা
|
দফতর |
বরাদ্দ* |
ছাড়া হয়েছে* |
শতাংশে |
অনগ্রসর উন্নয়ন |
৪৪৩ |
৩৯৩ |
৮৭ |
নগরোন্নয়ন |
১২৩৪ |
৯৫৭ |
৭৮ |
পূর্ত |
৩৮৫ |
২৯৯ |
৭৭ |
ক্রীড়া |
৯১ |
৬৯ |
৭৭ |
স্কুল-শিক্ষা |
২৭১৫ |
১৯১৩ |
৭১ |
কৃষি |
৩১৬ |
১৯৬ |
৬২ |
সংখ্যালঘু উন্নয়ন |
৫৭২ |
৩২৬ |
৫৭ |
স্বাস্থ্য |
১০৫২ |
৩৯৪ |
৩৮ |
সেচ |
১৫৭০ |
৫২৪ |
৩৪ |
উচ্চশিক্ষা |
২৪০ |
৮১ |
৩১ |
যুবকল্যাণ |
১০০ |
২৬ |
২৬ |
পরিবহণ |
৩৭৪ |
৭৭ |
২১ |
কৃষি বিপণন |
১৪৯ |
১৯ |
১২ |
* অঙ্ক কোটি টাকায় (১ এপ্রিল ২০১২ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩) |
|
|
|
|
|
|