শুরুতে সাফল্য আসেনি। তবে বছর না-ঘুরতেই টানাটানির সংসারে এখন সাশ্রয় হচ্ছে রাজ্যের। সৌজন্য, ই-টেন্ডার।
শুরু হয়েছিল উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা পরিষদের হাত ধরে, ২০১০ সালে। সে বার বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজের জন্য অনলাইন-দরপত্র চেয়েছিল জেলা পরিষদ। কিন্তু নতুন ব্যবস্থা নিয়ে নানা মহল থেকে আপত্তি ওঠায় আর এগোয়নি তদানীন্তন বাম সরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতার আসার পরে জাতীয় ই-গভর্ন্যান্স প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি দফতরের কাজের জন্য ই-টেন্ডার ব্যবস্থা চালু করে। প্রথম দিকে হোঁচট খেলেও এখন সুফল পেতে শুরু করেছে বিভিন্ন দফতর। মহাকরণের খবর, ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কাজের বরাত দেওয়ায় এখন ৫ থেকে ১৫% পর্যন্ত অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে।
অথচ বছরখানেক আগেও ছবিটা এমন ছিল না। মহাকরণের খবর, অনলাইনে দরপত্র দিতে হবে জেনে প্রথম দিকে বেঁকে বসেছিলেন ঠিকাদাররা। সরকারি কর্তা ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঠিকাদারদের অভিযোগ, কোনও প্রকল্পের জন্য দরপত্র চাওয়া হলেই একটি চক্র আড়াল থেকে সক্রিয় হয়ে উঠত। এই চক্রে সংশ্লিষ্ট দফতরের এক শ্রেণির অফিসার-কর্মী এবং অবশ্যই ঠিকাদাররা থাকতেন। সরকারি পরিভাষায় এই চক্রকে ‘প্যাক্ট’ বলা হয়। এই চক্রের মাধ্যমেই ঠিক হত, কে কোন কাজ পাবেন। যিনি কাজটা পেতেন, তিনি সবচেয়ে কম দর দিয়ে আবেদন করতেন। বাকিরা জেনেবুঝেই দর দিতেন বেশি। বিনিময়ে কাজ-পাওয়া ব্যক্তির কাছ থেকে ‘কমিশন’ পেতেন তাঁরা। এই ভাবেই চক্রের সাহায্যে গোটা প্রক্রিয়াটা চলত।
পূর্ত দফতরের এক কর্তা বলেন, “চক্র বা ‘প্যাক্ট’-কে এড়িয়ে কোনও ঠিকাদার দরপত্র জমাই দিতে পারতেন না। জেলার কাজের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হতো না। সংশ্লিষ্ট দফতর বা বিভাগের এক শ্রেণির অফিসার-কর্মীদের সঙ্গে যোগসাজসের মাধ্যমে চক্র জেনে যেত, অন্য কেউ দরপত্র দিতে চাইছেন কিনা। এমন ক্ষেত্রে সেই ঠিকাদারকে নরমে-গরমে বিরত করা হতো।” আবার, অনেক ক্ষেত্রে চক্রে জড়িত সরকারি কর্তারা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ‘টেন্ডার বক্স’ খুলে কারা দরপত্র জমা দিয়েছেন, তা দেখে নিতেন বলে অভিযোগ। সেই মতো সক্রিয় হয়ে উঠত চক্র।
মহাকরণের কর্তাদের মতে, এই মৌরসিপাট্টায় আঘাত পড়বে বুঝতে পেরেই প্রথম দিকে নানা অজুহাত তুলে অনলাইন দরপত্র দিতে আগ্রহ দেখাননি ঠিকাদাররা। তাই একই কাজের জন্য একাধিক বার বিজ্ঞাপন দিয়ে দরপত্র চেয়েও আবেদনপত্র পাওয়া গিয়েছে হাতেগোনা।
ছবিটা বদলাল কী ভাবে? একাধিক দফতরের অফিসাররা জানান, এক দিকে চক্র ভাঙতে প্রশাসন যেমন সক্রিয় হয়েছে, তেমনই অনলাইন-দরপত্র জমা দেওয়ার জন্য কী করতে হবে তা বোঝাতে ঠিকাদারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এতে সুবিধা কী, তা-ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
ই-টেন্ডারিংয়ের ফলে আর্থিক সাশ্রয়ও হয়েছে সরকারের। বিভিন্ন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে,
• আগে সংবাদমাধ্যমে বড় করে বিজ্ঞাপন দিয়ে দরপত্র চাওয়া হতো। এখন চার লাইনের একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে শুধু ওয়েবসাইটের ঠিকানা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের আবার ই-মেল করে জানিয়ে দেওয়া হয় দরপত্র চাওয়ার খবর। ফলে খরচ কমেছে।
• আগে টেন্ডার ফর্ম বিলি করা এবং জমা নেওয়ার জন্য পৃথক ব্যবস্থা রাখতে হতো। এখন সেই বাবদ খরচের বালাই নেই।
• আগে ‘প্যাক্ট’ করে সবচেয়ে কম যে দরপত্র জমা পড়ত, অনেক সময় তা সরকারের প্রাথমিক ভাবে ঠিক করা প্রকল্প খরচের (বেস প্রাইস) চেয়ে বেশি হতো। এখন কোন ঠিকাদার সংস্থা কী সর্বনিম্ন দর দিয়েছে, তা জানার উপায় নেই। কারণ, অনলাইন ব্যবস্থা চালু হওয়ায় জমা পড়া দরপত্রের বিশদ বিবরণ অগ্রিম জানতে পারছেন না অফিসারেরাও। পাসওয়ার্ড থাকছে দফতরের দু’এক জনের হাতে। নির্দিষ্ট দিনের আগে সেই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে কেউ দরপত্র দেখার চেষ্টা করলে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে কাজ আদায় করার জন্য কম লাভ রেখে দরপত্র জমা দিচ্ছেন আবেদনকারীরা। অনেক ক্ষেত্রে তা ‘বেস প্রাইস’-এর চেয়ে কম। এর ফলে প্রকল্প-নির্মাণের খরচও কম পড়ছে।
মহাকরণ সূত্রে বলা হচ্ছে, পূর্ত, সেচ, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর এবং জেলা পরিষদের মাধ্যমেই সাধারণত পরিকাঠামো উন্নয়নের অধিকাংশ কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই ই-টেন্ডারিং চালু করে এখন সাশ্রয় হচ্ছে সরকারের। যেমন, কেন্দ্রের বিআরজিএফ প্রকল্পে রাস্তা তৈরির জন্য গত আর্থিক বছরে ১৪৭৪ কোটি টাকা পেয়েছে পূর্ত দফতর। ওই টাকায় ১৪১টি ছোট-বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তারা। প্রতিটি কাজেরই বরাত দেওয়া হয়েছে ই-টেন্ডারের মাধ্যমে।
বছর শেষে হিসাব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সব মিলিয়ে প্রায় ৮৫ কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হয়েছে। ওই টাকা নতুন কয়েকটি প্রকল্প তৈরি এবং পুরনো কিছু প্রকল্প সম্প্রসারণের কাজে খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পূর্ত দফতর। প্রশাসনের দাবি, পূর্ত ও সেচ দফতর এবং বিভিন্ন জেলা পরিষদ মিলিয়ে গত এক বছরে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। ই-টেন্ডারিংয়ের ফলে কয়েকশো কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
নতুন ব্যবস্থাকে স্বাগত জানাচ্ছেন ঠিকাদাররাও। তাঁদের কথায়, “১৮টি রাজ্যে ই-টেন্ডার চালু হয়ে গিয়েছে। এতে আমাদেরও লাভ হয়েছে।
প্রধান কারণ, এই প্রক্রিয়া অনেক বেশি স্বচ্ছ্ব।”
|