পদ্মার ইলিশ পাতে পড়লেই মুখ বেজার হয়ে যেত চর রাজাপুরের মৎস্যজীবী সনাতন মণ্ডলের। রোজ রোজ কি আর ইলিশ খেতে ভাল লাগে? তাই মুখের স্বাদ বদলাতে একটা কচি লাউ, কি একজোড়া নারকোলের বদলে জেলেরা দিয়ে দিতেন আস্ত একটা ইলিশ!
সে বছর কুড়ি আগের কথা। আর এখন? প্রৌঢ় সনাতনের আক্ষেপ, “সে পদ্মাও নেই, নেই সেই ইলিশও। জালে ইলিশ পড়া তো দূরের কথা, ইলিশের স্বাদ কেমন তাই ভুলে গিয়েছি। সাগরপাড়া বাজারে মাঝেমধ্যে এক দেড় সের ওজনের পদ্মার ইলিশ উঠছে বটে। তবে তার যা দাম, তাতে সাড়ে তিন থেকে চার মণ ধান কেনা যায়।’’
পদ্মাপাড়ের এলাকাগুলোতে একটা সময় ইলিশ ছাড়া জামাইষষ্ঠীর কথা ভাবাই যেত না। এখন সাগরপাড়ার চম্পা মণ্ডল বলেন, ‘‘ইলিশ ছাড়া আবার জামাই আদর হয় নাকি? অথচ সেটাই করতে হচ্ছে। বাইরে থেকে যে ইলিশ আসে তার স্বাদ আর পদ্মার ইলিশের স্বাদের কোনও তুলনা হয় না।’’
সদয় পদ্মা কৃপণ হয়ে গেল কেন? |
মুর্শিদাবাদের সহ মৎস্য অধিকর্তা মলয় সাহুর মতে, “সমুদ্র থেকে ইলিশ নদীতে ঢোকে ডিম পাড়ার জন্য। কিন্তু এখন তারা ঢুকতেই পারছে না। কারণ নদীতে ঢোকার মুখেই বহু মাছ ধরে ফেলা হচ্ছে। কিছু মাছ যদিও বা ঢুকে ডিম পাড়ছে কিন্তু সেই ডিমও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের ফলে। এরপরে যদিও বা কিছু ইলিশ হচ্ছে সেগুলো বড় না হতেই ধরা হচ্ছে।”
মলয়বাবুর কথার মিল পাওয়া যায় চর রাজাপুরের সনাতন মণ্ডল, রানিনগরের পরাণ মণ্ডল কিংবা বামনাবাদের সুধন্য মণ্ডল, মহাবীর মণ্ডলের কথাতেও। তাঁদের কথায়,“বাপ ঠাকুর্দার আমল থেকে আমরা পদ্মার উপরেই নির্ভরশীল। একশ্রেণীর মানুষের ক্রমাগত অত্যাচারে পদ্মা আজ আর সদয় নয়। মৎস্যজীবী নয় এমন বহু সম্পন্ন মানুষ ‘কাপড়া’ জাল ও ‘ বিষাক্ত ওষুধ’ দিয়ে সহজে মাছ ধরে পদ্মাকে শেষ করে ফেলল।” তাঁরাই জানান, কাপড়া জাল এতটাই ঘন যে ছোট মাছ তো বটেই মাছের ডিম পর্যন্ত এই জালে আটকে যায়। কাপড়ের মতো ঘন জাল বলে স্থানীয় লোকজন একে ‘কাপড়া জাল’ বলে থাকেন।
‘ফিসারমেন অফ দ্য কোস্টাল ডিস্ট্রিক্ট অফ বেঙ্গল’ গ্রন্থের লেখক তথা কান্দির জেমো নরেন্দ্রনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক সূর্যেন্দু দে বলেন, ‘‘প্রজননের ক্ষেত্রে নানাবিধ বাধার কারণে ইলিশ মাছ কমে যাচ্ছে। তাছাড়া পদ্মার উপর লাগামছাড়া অত্যাচারের কারণে ইলিশের পাশাপাশি অন্যান্য মাছও কমে যাচ্ছে। তাই বিপন্ন হচ্ছেন মৎস্যজীবীরাও।’’
মুর্শিদাবাদের সহ মৎস্য অধিকর্তা মলয় সাহু বলেন, “এরকম যাতে না হয় তার জন্য আইনও তৈরি হয়েছে।’ ডোমকলের মহকুমাশাসক প্রশান্ত অধিকারী বলেন, ‘‘আমরা অবিলম্বে এই বিষয়ে মৎস্য দফতরের সঙ্গে কথা বলব। সেই সঙ্গে মৎস্য দফতর ও মহকুমা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে বিভিন্ন এলাকায় সচেতনতা শিবিরও করা হবে। সেইসঙ্গে নদীর উপরে যাতে অত্যাচার না হয় সেই বিষয়েও কড়া নজর রাখা হচ্ছে।’’
|