প্রবন্ধ...
শুধু ওঁদের শেখাব? নিজেরা শিখব না?

অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, উটপাখি

নিয়মরাজা আমাদের দেবতা। যত দিন নিয়মগিরি বাঁচবে, তত দিন আমরা বাঁচব। পাহাড় যদি মরে, নদী মরে যাবে, জঙ্গল মরে যাবে, আমরা মরে যাব। আমরা বেঁচে থাকতে নিয়মগিরিকে ভাঙতে দেব না।
হাজার দশেক মানুষের সমস্বর। ওড়িশার কালাহান্ডি আর রায়গড়া জেলায় ছড়িয়ে থাকা নিয়মগিরি পাহাড়ের কোলে থাকেন তাঁরা। বেশির ভাগই ডোঙ্গরিয়া কোন্ড জনজাতির। ডোঙ্গর মানে পাহাড়। জীবনের গভীরতম অর্থে ওঁরা পাহাড়ের সন্তান। পাহাড় তাঁদের ধর্ম বহু শতাব্দী ধরে পাহাড় তাঁদের ধারণ করে রেখেছে। নিয়মগিরির সবচেয়ে উঁচু যে পাহাড়, হুন্ডালজলি, সেখানেই থাকেন নিয়মরাজা। তাঁদের দেবতা।
তাতে আমাদের কী এসে গেল? আমাদের দেবতা তো উন্নয়ন। সেই যে কৃষি থেকে শিল্প, গ্রাম থেকে শহর, এটাই তো উন্নয়ন। এটাই তো ইন্ডিয়ার কথা। একাধারে নরেন্দ্র মোদী ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা। এবং জওহরলাল নেহরুর। আধুনিক ভারতের মন্দির কাকে বলে, ইন্ডিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রীই চিনিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সব মন্দির তৈরির জন্য (আদিবাসী) মানুষকে ত্যাগস্বীকার করতে হবে, এ-ও তো তাঁরই বাণী।
অতএব হুকুম জারি হয়, নিয়মগিরির পাহাড় ভাঙা হবে। কারণ, সেই পাহাড়ের পাথরে আছে বক্সাইট। ২০০৪ সালে বহুজাতিক সংস্থা বেদান্ত ওড়িশা সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে, কালাহান্ডি জেলার লাঞ্জিগড়ে অ্যালুমিনিয়ম কারখানা তৈরি করবে। সে জন্য বক্সাইট চাই। সেই চাহিদার একটা অংশ আসবে নিয়মগিরি থেকে। সেখানে জমে আছে প্রায় আট কোটি টন বক্সাইট। বেদান্ত’র সহযোগী সরকারি সংস্থা ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশন পাহাড় ফাটিয়ে সংগ্রহ করবে সেই কাঁচামাল। অহল্যা উদ্ধার, একুশ শতক।
কিন্তু একুশ শতক আবার ঈষৎ বেয়াড়াও বটে। ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের উন্নয়ন দেব’ বলে সর্বদা পার পাওয়া যায় না। নিয়মগিরি ভাঙার প্রতিবাদ উঠল শুরুতেই। প্রতিবাদ করলেন আদিবাসী মানুষ। বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন সমাজকর্মী শামিল হলেন সেই প্রতিবাদে। ‘বহিরাগত’ বলে তাঁদের খাটো করার চেষ্টা চলল, কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধে হল না, প্রতিবাদীরা সপাট জবাব দিলেন: বেদান্ত কি অন্দরাগত? ইতিমধ্যে নতুন অরণ্য আইন (২০০৬) পাশ হয়েছে, সেখানে আরণ্যক আদিবাসী মানুষের বিশেষ অধিকার নির্দিষ্ট হয়েছে। ডোঙ্গরিয়া কোন্ডরা আবার সংবিধানে আদি জনজাতির তালিকায়, বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক নিয়মগিরির অরণ্য-পর্বতে বক্সাইট খননের অনুমোদন বাতিল করে দিলেন।

শুনুন। গ্রামসভা, কালাহান্ডি, জুলাই ২০১৩। ছবি: পি টি আই
সুপ্রিম কোর্টে মামলা হল। সওয়াল-জবাব চলল। ১৮ এপ্রিল ২০১৩ সর্বোচ্চ আদালত রায় দিলেন, স্থানীয় মানুষের অনুমোদন ছাড়া পাহাড়ে হাত দেওয়া যাবে না। তিন বিচারকের ডিভিশন বেঞ্চ স্পষ্ট ভাষায় জানালেন, বক্সাইট সংগ্রহের প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ফলে স্থানীয় অরণ্যজীবী মানুষের ‘সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, কৌম এবং ব্যক্তিগত’ অধিকার কোনও ভাবে লঙ্ঘিত হতে পারে কি না, গ্রামসভা ডেকে তার বিচার করতে হবে। এত দিন সরকারি কর্তারা মনে করতেন, গ্রামসভার মতামত শোনা যেতে পারে, কিন্তু তা মানা-না-মানা রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন। সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার জানিয়ে দিল, গ্রামসভার কথাই শেষ কথা। সরকার মানুষের ভালমন্দের দায়িত্ব নেবে, এটা যথেষ্ট নয়। কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ, তা স্থির করবেন মানুষ নিজে। ওয়েলফেয়ার থেকে এজেন্সি, জনকল্যাণ থেকে জনসাধারণের সক্রিয় ভূমিকা, এটাই তো উন্নয়ন।
১৮ জুলাই থেকে ১৯ অগস্ট, এক মাসে দুই জেলায় মোট বারোটি গ্রামসভা বসেছে। সব ক’টি সভায় সব মিলিয়ে শ’চারেক মানুষ, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠই নারী, সম্পূর্ণ একমত হয়ে জানিয়ে দিয়েছেন: নিয়মগিরি যেমন আছে তেমন থাকবে। এ বার রাজ্য প্রশাসন গ্রামসভাগুলির রিপোর্ট পাঠাবে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে, তারা সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। সিদ্ধান্ত কী হবে, তা নিয়ে অবশ্য কারও সংশয় নেই। ওড়িশা সরকার এখন চেষ্টা করছে, বক্সাইটের বিকল্প ব্যবস্থা কী করা যায়। বিকল্প নেই, তা নয়। গোটা দেশে যত বক্সাইট, তার অর্ধেকের বেশি ওড়িশাতেই। তবে নিয়মগিরির আট কোটি টন আপাতত নাগালের বাইরে।
আপাতত। লড়াই জেতা আর যুদ্ধ জয় করা এক কথা নয়। বহুজাতিক কোম্পানি এবং রাষ্ট্র বনাম আট-দশ হাজার অরণ্যচারী আদিবাসী যুদ্ধটা কঠিন। কিন্তু এই দ্বৈরথে ওয়াকওভার পাওয়া ক্রমশই অসম্ভব হয়ে উঠছে। পাহাড়ে বক্সাইট আছে, তাই পাহাড় আমার চাই, তাতে যত গ্রাম উৎখাত হয় হোক এই দাপট আজ আর চলবে না, অন্তত সর্বদা সর্বত্র চলবে না। ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশন এখন বলছে, আদিবাসী এলাকায় খনি তৈরির দরকার হলে সেখানকার কমিউনিটির উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করা দরকার। অর্থাৎ ক্ষতিপূরণ।
ক্ষতিপূরণের ধারণাও ক্রমশ পালটাচ্ছে। তার পিছনে আছে অধিকারের পরিবর্তনশীল ধারণা। সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি একটি মামলায় যে রায় দিয়েছে, তাতে খনিজ সম্পদের উপর স্থানীয় মানুষের অধিকারের স্পষ্ট স্বীকৃতি আছে। এবং নিয়মগিরির ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের রায় স্থানীয় মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানার গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং কৌম’ অধিকারকে গুরুত্ব দিয়েছে। এই রায় নির্দিষ্ট ভাবে আরণ্যক এবং জনজাতীয় সমাজের জন্য। কিন্তু এই রায়ের অন্তর্নিহিত আদর্শ কেন যে কোনও জনগোষ্ঠী বা সমাজের ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবে প্রয়োগ করা হবে না, সে প্রশ্ন উঠবেই। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিনের জীবন-অনুশীলনের মধ্য দিয়ে একটা সমাজ তৈরি করে, সামাজিকতার একটা কাঠামো তৈরি করে। যে উন্নয়ন সেই সামাজিকতাকে অগ্রাহ্য করে, তার কাঠামোকে ‘অপারেশন সানশাইন’ করে গুঁড়িয়ে দিতে চায়, তার অশ্বমেধের ঘোড়াকে উত্তরোত্তর বাধা পেতে হবেই।
প্রশ্ন উঠবে, নিয়মগিরির জনজাতীয় মানুষ কি চিরকাল বিচ্ছিন্ন থেকে যাবেন? উন্নয়নের ‘মূলস্রোতে’ শরিক হবেন না? তাঁদের যথেষ্ট পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে এই প্রকল্প তৈরি করলে কি সকলেরই লাভ হত না? এই প্রশ্নে ‘উন্নত’ দুনিয়ার যে অহঙ্কার আছে, তাকে চিনে রাখা জরুরি। জনজাতির মানুষ যে অনেক বিষয়েই আমাদের মতো ‘মূলস্রোত’-এর সভ্যতাকাতর যন্ত্রমানবদের চেয়ে ভাল আছেন, সেই সত্যটিকে ওই অহঙ্কার নিরন্তর আড়াল করে রাখে। কিন্তু যদি সেই তর্কে আপাতত না-ও যাই, যদি ওই মানুষগুলোর ভাল করার প্রস্তাবকে ভাল মনেই গ্রহণ করি, তা হলেও সেই অমোঘ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়: এত দিন কোথায় ছিলেন? নিয়মগিরির একটি গ্রামসভাগুলিতে স্থানীয় প্রশাসনের আধিকারিকদের হাজির থাকতে হয়েছিল। এমনই একটি সভা বসেছিল জেলা-সদর থেকে পঁচাত্তর কিলোমিটার দূরে, পাহাড়ের উপরে একটি গ্রামে। রাস্তা মানে পাথর, মাটি আর কাদা। কালাহান্ডির সরকারি কর্তা ফিরে এসে বলেছেন, “এমন প্রত্যন্ত গ্রাম আমি কখনও দেখিনি। স্কুল নেই, হাসপাতাল নেই, বিদ্যুৎ নেই, কিচ্ছু নই।” মনে পড়ল নিয়মগিরির আন্দোলন নিয়ে তৈরি একটি তথ্যচিত্রের এক দৃশ্য। এক গ্রামবাসী তরুণ বলছিলেন, “আমরা আমাদের মতো আছি, আমরা সরকারকে চিনি না, সরকারের কেউ কখনও এখানে আসেনি, আসার দরকারও নেই।” এত কাল পরে, ঠিক যখন বক্সাইটের ইজারা নেওয়ার দরকার হল, তখনই ওঁদের মূলস্রোতে আনার তাগিদ জাগ্রত হল?
আর, আমরাই কেবল ওঁদের উন্নত করব? শেখাব? বোঝাব? বুঝব না? শিখব না? প্রথম যখন নিয়মরাজার কথা শুনি, উদার গণতান্ত্রিক অনুকম্পায় ভেবেছিলাম: এ তো সেই আদিম বিশ্বাস নানান প্রাকৃতিক ঘটনার বৈজ্ঞানিক কারণ জানা ছিল না বলে যে মানুষ প্রকৃতিকে দেবতা মনে করত, তাকে ভয় পেত, তার পুজো করত, এ তো সেই মানুষের ধারণা; তাকে জোর করে দমন করার অধিকার নিশ্চয়ই নেই আমাদের, কিন্তু তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি। তার পর বোধোদয় হল। জানলাম, বক্সাইটসমৃদ্ধ পাথর থাকে নিয়মগিরির পাহাড়ের উপর দিকে, সেই পাথর বৃষ্টির জল ধরে রাখে, সারা বছর সেই জল নদী হয়ে নেমে আসে, পাহাড়ের কোলে গ্রামগুলি জল পায়, বাঁচে। বক্সাইট বললে আমরা মূলস্রোতরা অ্যালুমিনিয়ম বুঝি, ওঁরা প্রান্তিকরা বোঝেন নদী। বোঝা আর জানা আর শেখার বিনিময়টা কেবল একতরফাই চলবে? এটাই উন্নয়ন? এটাই মূলস্রোত?
ডোঙ্গরিয়া কোন্ডরা বিপন্ন জনজাতি। বিপন্ন তাঁদের নিয়মরাজা, তাঁদের অরণ্য, তাঁদের নদীর স্রোত। কে জানে, মূলস্রোত তার উন্নয়ন সমেত আরও বিপন্ন কি না।
মেক্সিকোর এক পাহাড়ে রুপো আছে। তার দাম অন্তত একশো কোটি ডলার। একটি কানাডিয়ান কোম্পানি পনেরো বছরের জন্য সেই পাহাড়ের ইজারা নিতে চায়। স্থানীয় আদিবাসী মানুষ সেই প্রকল্প রুখে দিয়েছেন। তাঁদের বিশ্বাস, ওই পাহাড়ে সূর্যের জন্ম হয়েছিল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.