মনীশ তিওয়ারি মনে করেন, সাংবাদিকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া দরকার, তাঁহাদের জন্য একটি অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষারও বন্দোবস্ত থাকা উচিত এবং সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার পর সাংবাদিকতার পেশায় প্রবেশের জন্য তাঁহাদের প্রয়োজনীয় ‘লাইসেন্স’ বা অনুমতিপত্র থাকাও জরুরি। তিনি যখন এই প্রসঙ্গে ওকালতি ও ডাক্তারি পেশার সহিত তুলনা টানিয়াছেন, তখন ধরিয়া লওয়া যায়, শিক্ষার পাঠ্যক্রম, প্রবেশিকা পরীক্ষার আয়োজন এবং লাইসেন্স জারির দায়, সবই সরকারের হস্তেই ন্যস্ত থাকুক, ইহাই তাঁহার অভিপ্রায়। শ্রীযুক্ত তিওয়ারি নিছক রাজনীতিক নহেন, তিনি কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী। তাঁহার এমন অভিপ্রায় গণতন্ত্রের পক্ষে একটি উদ্বেগজনক সংকেত। ইহা প্রকারান্তরে সাংবাদিকের স্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, অর্থাৎ তথ্যের অবাধ আদানপ্রদান এবং মত প্রকাশ ও পোষণের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করার অনুকূল মানসিকতাকে ব্যক্ত করে।
অন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন, সংবাদমাধ্যমের দুনিয়াতেও তেমনই উন্নতি সতত কাঙ্ক্ষিত এবং জরুরি। জনজীবনে সংবাদমাধ্যমের প্রভাব প্রবল বলিয়াই সাংবাদিকতার মান উন্নত রাখা আরও বেশি জরুরি। উৎকর্ষের সাধনা হইতে যে কোনও বিচ্যুতিই অনভিপ্রেত এবং সংশোধনযোগ্য। কিন্তু সরকারি বিধিনিষেধ, নিয়ন্ত্রণ বা শৃঙ্খলের নিগড়ে বাঁধিয়া উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতা উৎপন্ন করার চিন্তাটি পত্রপাঠ বর্জনীয়। সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করিতে সরকার-নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম অধ্যয়ন, সরকারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, সর্বোপরি সরকারি লাইসেন্স হাতে লইয়া তবে সাংবাদিকতার চাকুরিতে প্রবৃত্ত হওয়ার বন্দোবস্তটি সাংবাদিকদের উপর কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপেরই প্রয়াস। কিছু কাল আগে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু সাংবাদিক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতামান নির্ধারণের জন্য কমিটি গড়ার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। সেই প্রস্তাবটি যে যমুনার স্রোতে ভাসিয়া যায় নাই, কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচারমন্ত্রীর ‘সরব চিন্তা’ তাহারই প্রমাণ।
বিশ্বে এমন ‘গণতন্ত্র’র অভাব নাই, যেখানে এ ভাবে সাংবাদিকদের লাইসেন্স দিবার রীতি চালু আছে। এই বন্দোবস্তের মজা হইল, ক্রমশ ইহা সংবাদপত্র প্রকাশের জন্যও লাইসেন্স মঞ্জুরের অভিমুখে অগ্রসর হইতে পারে। তখন লাইসেন্স বাতিল করার হুমকিই সাংবাদিককুলকে তথা সংবাদপত্র বা আস্ত গণমাধ্যমকে অষ্টপ্রহর সরকারি নীতি ও কর্মসূচির বন্দনাগান গাহিতে বাধ্য করার পক্ষে যথেষ্ট গণ্য হইবে। সংবাদপত্র সে ক্ষেত্রে আর স্বাধীন, অনিয়ন্ত্রিত মতপ্রকাশের মাধ্যম থাকিবে না, সরকারি প্রচারযন্ত্রে পরিণত হইবে। গণতন্ত্রের নজরদার হিসাবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়িবে। মনীশ তিওয়ারি বরং ভাবিয়া দেখিতে পারেন, ভারতে যদি কোনও একক বৃত্তিজীবী গোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম পাঠ্যক্রম, প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং লাইসেন্স-এর আবশ্যকতা থাকে, তবে তাহা ভারতীয় রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেই বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য কি না। আইনসভার ভিতরে ও বাহিরে তাঁহাদের নিত্যদিনের ক্রিয়াকলাপ কিন্তু তেমন নিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতাই চিহ্নিত করে। সেই নিয়ন্ত্রণও নিশ্চয়ই যথার্থ ত হইবে না, তবে তিওয়ারিজির বিচারে তো যথার্থ গণতন্ত্র অপেক্ষা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণই বোধহয় অধিক মূল্যবান। |