খাদ্য নিরাপত্তা বিল লইয়া সাম্প্রতিক অতীতে কম আলোচনা হয় নাই। বিবিধ আপত্তি উঠিয়াছে। গণবণ্টন ব্যবস্থার দোষত্রুটি না শুধরাইয়াই সরকার কেন এত বড় প্রকল্পের পথে হাঁটিতে মনস্থ করিল, সেই প্রশ্ন যেমন উঠিয়াছে, তেমনই প্রস্তাবিত খাদ্যশস্যের মাপ লইয়াও কথা উঠিয়াছে। সরকারের আর্থিক সংগতি সংক্রান্ত প্রশ্নও জোরদার। অর্থনীতি যখন মুখ থুবড়াইয়া পড়িতেছে, তখন এই মাপের একটি প্রকল্প আরম্ভ করা কি হঠকারিতার পরিচায়ক নহে? এই প্রশ্নগুলির প্রতিটিই পদ্ধতি সংক্রান্ত, মূল নীতি বা আদর্শ সংক্রান্ত নহে। এমনকী, সরকারের আর্থিক সংগতির প্রশ্নটিও নহে। খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যদি সরকারের নীতি বলিয়া নির্ধারিত হয়, তবে তাহা করিতে হইবে সরকারের টাকা আছে কি নাই, তাহা আদর্শের মাপকাঠিতে বিবেচ্য নহে। দেশের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যেমন সরকারের কর্তব্য, সেই খাতে প্রয়োজনীয় টাকা রাজকোষে না থাকিলে ধার করিতে হইবে। প্রশ্ন হইল, খাদ্য নিরাপত্তা কি সরকারের কর্তব্য হিসাবে প্রতিরক্ষার গোত্রভুক্ত? যদি তাহা হয়, তবে অন্য ওজর-আপত্তির অবকাশ নাই। মূলগত প্রশ্ন দুইটি। এক, প্রতিটি মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা করা কি সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে? দুই, খাদ্যের অধিকার কি আদৌ একটি মৌলিক অধিকার হইতে পারে? এই দুইটি প্রশ্নের যথার্থ উত্তরের উপর খাদ্য নিরাপত্তা বিলের যৌক্তিকতা নির্ভর করিয়া আছে।
দুইটি প্রশ্নের উত্তরই নেতিবাচক। দেশের প্রতিটি মানুষ দুই বেলা পেট ভরিয়া খাইতে পান ইহা অপেক্ষা সুসমাচার আর হয় না। কিন্তু সেই খাদ্যের জোগান দেওয়া সরকারের আবশ্যিক কর্তব্য হইতে পারে না আইনি বাধ্যবাধকতা তো নহেই। দেশ আক্রান্ত হইলে সরকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিবে; অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখিবে; প্রশাসনিক কাজ যাহাতে নির্বিঘ্নে চলে, তাহা নিশ্চিত করিবে; অর্থনীতির প্রাথমিক চাহিদাগুলি পূরণ করিবে; এবং, মানুষের সুস্থ ভাবে বাঁচিয়া থাকিতে যে ইতিবাচক পরিবেশের প্রয়োজন, তাহা বজায় রাখিবে। কোনও প্রকৃত উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাহার নাগরিকদের অন্নসংস্থানের দায় বহন করে না। প্রত্যেকের শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেমন রাষ্ট্রের কাজ নহে, প্রত্যেকের অন্নসংস্থানও রাষ্ট্রের দায়িত্ব হইতে পারে না। তাহার অর্থ এই নয় একটি কথা স্পষ্ট বুঝিয়া লওয়া প্রয়োজন সরকার শিক্ষা বা খাদ্যসংস্থানের ক্ষেত্রে একেবারে হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিবে, তেমন দাবি কেহই করিবে না। কিন্তু, আইন করিয়া এই দায়িত্বগুলি সরকারের ঘাড়ে চাপাইয়া দেওয়া চলে না। সরকার কত দূর যাইবে, তাহা গণতান্ত্রিক পরিসরে নির্ধারিত হইবে। সমস্যা আইন লইয়া। খাদ্য নিরাপত্তা বিলের প্রশ্নে প্রথম আপত্তি ইহাই।
দ্বিতীয়ত, খাদ্যের অধিকার ‘মৌলিক অধিকার’ হইতে পারে না। তাহাকে সেই স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যে রাজনৈতিক চমক বিলক্ষণ আছে, কিন্তু বিবেচনা নাই। সংবিধানে যে মৌলিক অধিকারগুলি স্বীকৃত, সেইগুলির মধ্যে একটি মূলগত সাযুজ্য আছে অধিকারগুলি প্রকৃতপ্রস্তাবে কিছু অধিকার খর্ব না করিবার রক্ষাকবচ। সেই অধিকার লঙ্ঘিত হইলে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া চলে। নির্দেশমূলক নীতির সেই আইনি বাধ্যবাধকতা নাই। বিভাজনটি অবিবেচনাপ্রসূত নহে, অতএব রাজনীতির স্বার্থে তাহাকে লঙ্ঘন করা অনুচিত। শিক্ষার অধিকারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বস্তুত, মানুষের হাতে ‘অধিকার’ তুলিয়া দেওয়ার পথটি বিপজ্জনক এক বার চলিলে থামিবার উপায় নাই। খাদ্য বা শিক্ষা ‘অধিকার’ হিসাবে স্বীকৃত হইলে স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, নিকাশি, কর্মসংস্থানই বা কেন ‘অধিকার’ হইবে না, এই প্রশ্নের কোনও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর নাই। মানুষ যাহাতে পেট ভরিয়া খাবার পায়, সরকার তাহার পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া দিক। কিন্তু খাওয়াইবার দায়টি ঘাড়ে তুলিয়া লইলে বিপদ। |