এ এক আশ্চর্য রাত। মহাকাব্যের মহানায়ক এই রাতে ক্ষমতার মিনার থেকে নেমে আসেন। অপত্য স্নেহের কোমল আসনে বাৎসল্যের আবেগে ডুবে থাকা ভক্তজন তাঁকে ছুঁতে চান। কৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি জন্মাষ্টমীর সেই রাতে ভক্তি-শ্রাবণ হয়ে ফিরে আসে বারবার। হাজার বছরের প্রাচীন জনপদ নবদ্বীপ, গঙ্গার পূর্বপাড়ের মায়াপুর কিংবা পার্শ্ববর্তী শান্তিপুরের মানুষের কাছে জন্মাষ্টমীর রাত আর এক কোজাগরীর রাত। কৃষ্ণ কোজাগরী।
চৈতন্যধাম নবদ্বীপে মাত্র আড়াই কি তিন দশক আগেও নবদ্বীপের মানুষ বড় উৎসব বলতে বুঝতেন কেবল রাসযাত্রা। তারপর দিন যত গড়িয়েছে, ততই দীর্ঘ হয়েছে উৎসবের তালিকা। রথযাত্রা, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, নন্দোৎসব, রাধাষ্টমী প্রায় প্রতিটি উৎসবেই বাড়ছে আড়ম্বর, জনসমাগম। আক্ষরিক অর্থেই নবদ্বীপ বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশ হয়ে উঠেছে।
কেন এত উৎসব বেড়েছে? সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, ‘‘বিগত কুড়ি পঁচিশ বছরে নবদ্বীপের আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটা বড় বদল ঘটেছে। যার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি সাধারণ গৃহস্থ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচচার্। মঠ মন্দির বেড়েছে। বেড়েছে ভক্ত শিষ্যের সমাগম।” এই বিপুল ভক্তমণ্ডলীর তাগিদেই বেড়েছে উৎসবের সংখ্যাও। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “চৈতন্যদেব জীবনের সঙ্গে ধর্মকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অনুগামীরা চৈতন্যকে মনে করেন শ্রীকৃষ্ণের অবতার। ফলে তাঁদের কাছে কৃষ্ণ ভজনা এবং চৈতন্য ভজনা দুটোই এক তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের ব্যাপ্তিও বেড়েছে।’’ যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সব উৎসবের চরিত্রের বদল ঘটেছে। প্রতিটি উৎসবের সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছে স্থানীয় অর্থনীতি এবং পর্যটন। |
সেজে উঠছে মায়াপুর-ইস্কন মন্দির। —নিজস্ব চিত্র। |
শ্রীখোল বাজিয়ে বাংলা কীর্তনের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ বা রাজস্থানের ঘরানার দ্রুত লয়ের ঢোল সহযোগে হিন্দি ভজন এখন নবদ্বীপ, মায়াপুরের বিভিন্ন মঠ মন্দিরে হামেশাই শোনা যায়। পালাকীর্তনের আসরের পাশাপাশি হিন্দি ভাষার কথকতার আসরে উপচে পড়ছে ভিড়। মন্দিরের ভোগে নারকেল নাড়ুর থেকে লাড্ডু বেশি জনপ্রিয়। নবদ্বীপের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের প্রধান অদ্বৈত দাস বলেন, ‘‘আগে জন্মাষ্টমী মঠ মন্দির বা গৃহস্থের একান্ত নিজস্ব পালনীয় ছিল। এখন তা ক্রমশ সর্বজনীন উৎসবের চেহারা নিচ্ছে। বাড়ছে জাঁকজমক।’’
জন্মাষ্টমীর আগের দিনই ইস্কনের সমস্ত অতিথিশালা ভর্তি হয়ে গিয়েছে। নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান বাদল দত্ত বলেন, ‘‘উৎসব অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ জোগায়। নবদ্বীপের স্থানীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি পর্যটন। তাই ওই সব ধর্মীয় উৎসবগুলি যত বেশি হবে, তত বেশি পর্যটক। যত বেশি পর্যটক তত বেশি বাণিজ্য।” নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক উত্তম সাহাও বলেন, “নবদ্বীপের ব্যবসা বাণিজ্যে প্রতিটি উৎসবই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যত বেশি উৎসব, ততই ব্যবসায়ীদের লাভ।”
তাই গৃহস্থ বাড়ির ঠাকুরঘর থেকে পরিচিত মঠের নাটমন্দির সর্বত্রই সকাল থেকে সাজো সাজো রব। মল্লারে বাঁধা কীর্তনের আখরে, ভেজা বাতাসে অগুরু চন্দন, জুঁইয়ের ভারি গন্ধ সুর আর সুবাসে মাখামাখি দিন এগিয়ে চলে। তারপর মধ্যরাত্রে হঠাৎ বেজে ওঠে জন্মদিনের শাঁখ, ঘন্টা, মৃদঙ্গ। কৃষ্ণজন্মের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অষ্টমী তিথির মধ্যরাতে গঙ্গার দুই পাড়ের মন্দিরে মন্দিরে তখন হাজার ভক্তের থিকথিকে ভিড়। সে ভিড়ে মুম্বই থেকে মেদিনীপুর, রাজস্থান থেকে রায়না, বারুইপুর থেকে বরোদা সব একাকার হয়ে যায়। |